বাঁশখালী প্রতিনিধি >>>
করোনা সংকটে কর্মহীন অসহায় মানুষের মধ্যে সরকারের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির ত্রাণ বিতরণের তালিকা প্রণয়ন ও বরাদ্দ করা খাদ্যসামগ্রী বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৬ নম্বর বৈলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. কপিল উদ্দীনের বিরুদ্ধে। ত্রাণ বিতরণের জন্য তালিকা প্রণয়ন ছাড়াও সরকারের খাদ্য সহায়তার অংশ হিসেবে বরাদ্দ করা খাদ্য সামগ্রী বিতরণেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও আনা হয়েছে।
জানা গেছে, এ নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন ও বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোমেনা আক্তারের কাছে গত ১৮ মে মো. কপিল উদ্দীনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন স্থানীয় একই পরিষদের তিন ইউপি সদস্য। লিখিত অভিযোগে তারা উল্লেখ করেন, বর্তমান মহামারি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে সৃষ্ট দুর্যোগের বিশেষ মানবিক সহায়তা বাস্তবায়নে সরকারি নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে- পরিষদের মেম্বাদের ও সংরক্ষিত আসনের মেম্বারদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে গরীব, দুস্থ, বস্তিবাসী, ভাসমান মানুষ, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ব্যক্তি, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, বেকার শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, চা শ্রমিক, চা দোকানদার, দিনমজুর, রিক্সা/ভ্যানগাড়ি চালক, বিধবা নারী, বেদে ও হিজরা সম্প্রদায়, পথশিশু, নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের লোকসহ মানবিক সহায়তা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করতে হবে। কিন্তু চেয়ারম্যান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পাঠানো ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে এককভাবে প্রভাব খাটিয়ে ইচ্ছেমাফিক তালিকা প্রণয়ন করেছেন। এছাড়া ত্রাণ বরাদ্দের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি ইউপি সদস্য মো. খালেক, নুর মো. জামাল উদ্দীন ও মো. দিদারুল হককে জানিয়ে দেন- কোনো অনুদান আসেনি। তোদেরকে কোনো বরাদ্দ দেব না, যা পারিস কর বলে গালিগালাজ করে লাঞ্ছিত ও অপমাণ করে। লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়- এর আগেও বিভিন্ন সময় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ বরাবর অনুদান বা ত্রাণ পাঠালে তা নিজের ইচ্ছেমতো বিতরণ করেন চেয়ারম্যান কপিল। এমনকি ত্রাণ কমিটির বিষয়ে আমাদের তিনজনকে কোনো প্রকার চিঠি বা মৌখিকভাবেও অবগত করেননি। চেয়ারম্যানের গঠিত তালিকায় গরীব, দুস্থ, অসহায় লোকজনকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করে- এরকম বিত্তশালী ব্যক্তিকেও মানবিক সহায়তা পাওয়ার তালিকায় নাম রাখে।
গরীবের ‘দুস্থ মানবিক সহায়তা তালিকা’য় ২৪০ নম্বর ক্রমিকে চেচুরিয়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত ফরিদ আহমদের পুত্র রাশেদ আলীর নাম রয়েছে। যিনি বিগত ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থনে বৈলছড়ি ইউনিয়ন থেকে ২ বার শক্তিশালী ক্ষমতাবান চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন। তিনি বাঁশখালীর এতিহ্যবাহী একটি জমিদার পরিবারের সন্তান। এছাড়াও ৪১ নম্বর ক্রমিকে বৈলছড়ির ২ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত মঞ্জুর আহমদ চৌধুরীর ছেলে মো. ইউনুছ শুধু বিত্তবানই নন, প্রতিষ্ঠিত একজন কাঠ ব্যবসায়ীও। তার এক ছেলে সরকারি চাকুরীজীবীঅ। ৭২ নম্বর ক্রমিকে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মো. কামাল বশরের স্ত্রী জারিয়া ও ৩৯ নম্বর ক্রমিকে মৃত নুরুল কবির চৌধুরীর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস- এই ব্যক্তিবর্গ শুধু বিত্তবানই নন, অঢেল ধন-সম্পদের মালিক ও মার্কেটের মালিক। ২৬১ নম্বর ক্রমিকে চেচুরিয়ার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নবাব আলীর ছেলে শাহিন শাহ নামের একজন ব্যাংক কর্মকর্তার নাম মানবিক সহায়তা পাওয়ার তালিকায় স্থান পায়। তদন্ত করলে আরো অনেক বিত্তশালীদের নাম-পরিচয় উক্ত তালিকায় পাওয়া যাবে।
অভিযোগে আরো জানানো হয়, বিগত আড়াই বছর ধরে চেয়ারম্যান মো. কপিল উদ্দীন ইউনিয়ন পরিষদে কার্যক্রম পরিচালনা না করে নিজ বাড়িতে বসে পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ইউপি সদস্যদের সরকার নির্ধারিত ৮ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা হতে ৪ হাজার ৪’শত টাকা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তাদেরকে তিন বছর ধরে কোনো প্রকার সরকারি ভাতা প্রদান করেননি। বিশেষ করে এই করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ এলেও নিজ এলাকার প্রকৃত অভাবীরা তা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অসহায় বোধ করছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করেছেন তিন ইউপি সদস্যরা।
তবে, এ অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান মো. কপিল উদ্দীন দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, জেলা প্রশাসক ও ইউএনও বরাবরে কি বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, তা সঠিক জানা নেই। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর নাম দুস্থদের তালিকায় রয়েছে- এমন অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তিনি জানান, উনি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন দুইবার তা ঠিক। কিন্তু বর্তমানে তিনি কর্মহীন মানুষ। উনার কোনো ছেলে চাকুরি করে না। বর্তমানে বেকার। উনি ডায়াবেটিস রোগী এবং কিডনী রোগে আক্রান্ত। তিনি তার ভাইয়ের বাসায় থাকেন। তাই তার নাম তালিকায় দিয়েছি।
তিন ইউপি সদস্যদের সম্মানী ভাতা না দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইউপি সদস্যদের সম্মানী ভাতা তো সোনালী ব্যাংকে তাদের নিজস্ব একাউন্ট সরাসরি জমা হয়। পরিষদের তো কোনো ইনকাম নাই। আমাদের ইনকাম থাকলেইতো আমরা বেতন দিতাম। যেমন কালীপুর, চাম্বল ও পৌরসভাসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে ইনকাম আছে। আমাদের পরিষদে তো তেমন কোনো ইনকাম নাই। বাঁশখালীর সবচেয়ে ছোট ইউনিয়ন হচ্ছে আমার এই বৈলছড়ি ইউনিয়ন। তিন ইউপি সদস্যদের কাছ থেকে তালিকা না নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেম্বার খালেক ও মেম্বার দিদার মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি। তাদের বিরুদ্ধে আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি ফৌজদারী মামলাসহ ৭-৮টি মামলা রয়েছে। পরিষদের সিসি ক্যামেরা ভাঙার মামলার আসামিও তারা। তাদের আচরণতো পরিষদ পরিপন্থী। অপর ইউপি সদস্য মো. জামাল ছিনতাই মামলার আসামি। একজন পরিষদের মেম্বার যদি ছিনতাই মামলার আসামি হয় তাহলে এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কি হতে পারে! তাদের অভিযোগের কোনো সত্যতা নাই বলেও তিনি জানান।
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোমেনা আক্তার অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, অভিযোগ জেলা প্রশাসক মহোদয় এবং আমার কাছে জমা দিয়েছেন। অভিযোগগুলো ক্ষতিয়ে দেখা হবে।
ডিসি/এসআইকে/এমএমবিটি