বিকল্প না রেখেই ব্রিজের কাজ শুরু, চরম দুর্ভোগে লামা-লোহাগাড়ার হাজারো মানুষ

লামা (বান্দরবান) প্রতিনিধি >>>
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলা ও চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার সীমান্তে সরইখালের ওপর হাসনা ভিটা নামক স্থানের সেতুটির পুন:নির্মাণ কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।  কিন্তু সেতু নির্মাণ করার আগে যাতায়াতের জন্য সেতুর পাশে আরেকটি বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।  ফলে সরই-লোহাগাড়া সড়ক দিয়ে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।  এতে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন ওই পথে যাতায়াতকারী শিক্ষার্থী, পর্যটকসহ স্থানীয় হাজারো মানুষ।  বিশেষ করে চলতি মৌসুমে পার্বত্য লামা উপজেলার কয়েকশ বাগানে উৎপাদিত আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচুসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণে দারুণ ব্যঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।  এতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বাগান মালিকসহ স্থানীয় কৃষকেরা।  এসব অভিযোগ জানার পরও বিকল্প যাতায়াতের ব্যবস্থা করছে না ঠিকাদার।  শুধু তাই নয়, ঠিকাদারের বিরুদ্ধে নির্মাণ কাজে ধীরগতিরও অভিযোগ স্থানীয়দের।  দ্রুত যাতায়াতের জন্য বিকল্প ব্যবস্থাসহ সেতুটি নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন দুই উপজেলার মানুষ।  তা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সরই নামের একটি খাল।  এ খালের একপ্রান্তে পার্বত্য লামা উপজেলার সরই ইউনিয়ন, অন্যপ্রান্তে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলা ইউনিয়ন।  দুইপারের মানুষের যোগাযোগের সুবিধার্তে ২০ বছর আগে খালের হাসনাভিটা নামক স্থানে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ করে বান্দরবানের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।  এ সেতুটিই ছিল দুই উপজেলার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম।  প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে পার্বত্য লামা উপজেলায় অবস্থিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে শত শত পর্যটক আসা-যাওয়া করেন।  কিন্তু বিভিন্ন সময় স্থানীয় ও বহিরাগত কিছু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এ সেতুর দু’পাশ থেকে অবাধে বালু উত্তোলনসহ ধারণ ক্ষমতার অধিক যানবাহন চলাচলের কারণে গোড়া থেকে মাটি সরে গিয়ে নড়েবড়ে হয়ে যায় সেতুটি।  এক পর্যায়ে অতিবর্ষণে সৃষ্ট পানির স্রোতের টানে ২০১৮ সালের ২০ জুন সেতুটির এক পাশ ধসে পড়ে।  এতে ভারী যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও সেতুটির ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে পারত দু-পারের মানুষ।  দরপত্র আহবানের পর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পুন:নির্মাণের জন্য সেতুটির ছাদ ভেঙ্গে ফেলে।  এতে মানুষের যাতাযাত সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ও এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে গত তিন মাস আগে চট্টগ্রাম জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণের দরপত্র আহবান করে।  এতে সেতুটির নির্মাণ কাজটি পায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান শাহ্ জব্বারিয়া ট্রেডার্স।  গত তিন মাস আগে সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় এলজিইডি।
অভিযোগ ওঠেছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চলাচলের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করেই কাজের শুরুতেই শ্রমিক লাগিয়ে পুরাতন সেতুটির ছাদ ভেঙ্গে ফেলে।  এতে উভয়পাড়ের মানুষের যাতাযাত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জন দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে।  এছাড়া কার্যাদেশ মতে- গত তিন মাস আগে সেতু পুন:নির্মাণ কাজ শুরুর কথা থাকলেও নানা অযুহাত দেখিয়ে গত সপ্তাহে কাজ শুরু করে ঠিকাদার, তাও আবার কাজ চালছে কচ্ছপ গতিতে।
সেতুটির এক পাশ ধসে পড়ার পর গত বছর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইদ্রিস কোম্পানী নিজে উদ্যোগ নিয়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় পাশেই একটি বিকল্প কাঠের সেতু নির্মাণ করেন।  গত দু’বছর ধরে এ কাঠের সেতুর ওপর দিয়েই স্থানীয়রা সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, টমটমযোগে চলাচলসহ কৃষি পণ্য পরিবহন করে আসছিলেন।  কিন্তু টানা ভারী বর্ষণের ফলে বিকল্প এ কাঠের সেতুটিও গত মঙ্গলবার পানির স্রোতের টানে ভেসে যায়।  সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেতুর দুই পাশে আটকে আছে অন্তত অর্ধশত যানবাহন।  গাড়ি পরিবর্তন করে যাতায়াত করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।  এছাড়া সেতুটির লোহাগাড়া উপজেলার অংশে কিছু পাথরসহ নির্মাণ সামগ্রী জমা করে রেখেছে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ।  কয়েকজন শ্রমিককে সবেমাত্র একটি পিলারের পাইলিং করতে দেখা যায়।
স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইদ্রিস কোম্পানী ও সরই ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জানে আলম জানান, সেতুটির নির্মাণ কাজ চলছে ধীরগতিতে।  তিন মাসে শুধুমাত্র একটি পিলারের পাইলিং করা হয়েছে মাত্র।  তারা আরো বলেন, কাজে ধীরগতির কারণে যারা প্রতিদিন লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চট্টগ্রামে অফিস ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেন বা জরুরি প্রয়োজনে এ সড়ক দিয়ে বাধ্য হয়ে যাতায়াত করেন তারা পড়েছেন বিপাকে।  বিশেষ করে পার্বত্য লামা উপজেলায় উৎপাদিত কৃষি পণ্য বাজারজাতে দারুণ ব্যাঘাত ঘটছে।  দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতায়াতের বিকল্প রাস্তা তৈরি না করলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানববন্ধনসহ কঠোর কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হবো।
সড়কটি দিয়ে চলাচলকারী সিএনজি অটোরিকশাচালক আহমদুর রহমান, মোটরসাইকেল চালক হেমায়েত হোসেন, রিকশাচালক রিয়াত হোসেন এবং পথচারী জুলফুনা আক্তার বেবি দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন,  ক্যায়াজুপাড়া বাজার থেকে ব্রিজ পর্যন্ত যাওয়া যায়।  এরপর সেখানে নেমে যেতে হয়। বাধ্য হয়েই যাত্রীরা মালামাল কাঁধে নিয়ে পায়ে হেঁটে খাল পার হয়ে ওপারে গিয়ে আবার গাড়িতে ওঠেন।  তাও আবার খালে পানি কম থাকলে।  খালে বেশি পানি থাকলে তাও সম্ভব হয় না।  অনেক সময় হেঁটে খাল পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।
মেরিডিয়ান গ্রুপের আম বাগান ব্যবস্থাপক স্থানীয় মেহেদী হাসান বলেন, ইউনিয়নে বিভিন্ন কোম্পানী ও ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়েকশ আম বাগান রয়েছে।  ইতোমধ্যে এসব বাগানে এ আম পাকা শুরু করেছে।  কিন্তু সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আম বাজারজাতে শ্রম ও অর্থ- দুটোই বেড়েছে।  ফলে বাগান মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।  নির্মিতব্য সেতুর পাশে যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা করে দিলে দুর্ভোগ লাঘব হতো।
যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা না করে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সরই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ উল্ আলম ও লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইউনুছ বলেন, আমাদের দুর্ভোগ দেখার কেউ নেই।  এ সেতু নির্মিত হলে দুই উপজেলার কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হতো।  যাদের তিনবেলা ভাত খেতে কষ্ট হয়, তাদের সহায়তায় বিকল্প কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল।  অবশেষে সেই সেতুটিও স্রোতের টানে ভেসে গেল।  এতে দুই উপজেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকায় কৃষি খাত চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।  সেতু নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তারা।
তবে সেতু নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নুরুল আলম জিকু বলেন, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে সেতুটির নির্মাণ কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে।  তবে ইতোমধ্যে ২০% কাজ সম্পন্ন হয়েছে।  আশা করি আগামি ৫-৬ মাসের মধ্যে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে।  তিনি আরো বলেন, আগে বিকল্প যাতায়াতের জন্য সহযোগিতা করেছি।  বর্তমানেও স্থানীয়রা যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থার উদ্যোগ নিলে সহযোগিতা করা হবে।
লোহাগাড়া উপজেলা প্রকৌশলী দিবাকর রায় জানান, খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে।  ঠিকাদারের সাথে আলাপ করে যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে।

ডিসি/এসআইকে/এমআর