উত্তর কাট্টলীতে যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার, থানা ছাত্রলীগ সভাপতিসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
চট্টগ্রাম নগরের উত্তর কাট্টলীতে গলায় ফাঁস লাগানো এক যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে আকবরশাহ থানা পুলিশ।  আকবরশাহ থানাধীন উত্তর কাট্টলীর আমানত উল্লাহ শাহ পাড়া থেকে এই লাশ উদ্ধার করা হয়।  বুধবার (২৯ জুলাই) ভোরগত রাত সাড়ে ১২ টার দিকে লাশ উদ্ধার করা হলেও মঙ্গলবার রাত সোয়া আটটা থেকে লাশটি ঝুলছিল বলে জানান স্থানীয় প্রতিবেশিরা।  নিহত যুবকের নাম মো. শহিদুর রহমান রনি (২৮)।  তিনি আমানত উল্লাহ শাহ পাড়ার কসাই বাল্লা মিয়ার ছেলে বলে জানা গেছে।  রাত সাড়ে ১২ টার দিকে সিএমপির ফরেনসিক দল লাশটির সুরতহাল তৈরি শেষে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে।
তবে, নিহত যুবক শফিকুলের পরিবারের দাবি, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে আকবরশাহ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল সিদ্দীকি, স্থানীয় জব্বার আলী সারেং বাড়ির বদিউল আলমের ছেলে মো. শহিদুল, তার ভাগিনা তানজিল ও ফতেহ আহমেদ চৌধুরীর নতুন বাড়ির মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে মো. শহীদসহ কয়েকজন। জুয়েল, দুই শহীদ নিহত শহিদুর রহমান রনির বোন রেশমী আক্তারকে (২১) কু-প্রস্তাব দিয়ে নানানভাবে উত্যক্ত করতো বলে জানান তার পরিবার ও প্রতিবেশিরা।
এই ঘটনায় আজ বুধবার (২৯ জুলাই) আকবরশাহ থানা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ ৪ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে তার পরিবার।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র, নিহতের বোন রেশমি আক্তার, প্রতিবেশী সূত্রে জানা গেছে, মো. শহিদুর রহমান রনি তার ছোট ভাইকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের আমানত উল্লাহ শাহ পাড়ায় হায়দারের ভাড়া ঘরে বসবাস করছেন।  রনি ও তার ছোট ভাই রায়হান স্থানীয় হায়দার জমিদারের এক রুমের একটি বেড়ার ঘরে বসবাস করলেও বোন রেশমী ও মা শিরিন আক্তার ও বাবা খোকন মিয়া প্রকাশ বাল্লা মিয়া কসাই থাকতেন পেছনের আরেকটি কলোনীতে।  তার ছোট বোন রেশমী আক্তার (২১) বিবাহিত।  দীর্ঘদিন ধরে রেশমীকে উত্যক্ত করছিল স্থানীয় ফতেহ মোহাম্মদ চৌধুরীর নতুন বাড়ির মৃত আব্দুল মান্নান প্রকাশ মন্নাইয়োর ছেলে মো. শহীদ প্রকাশ শহীদ মেম্বার, তার বন্ধু জব্বার আলী সারেং বাড়ির মো. শহীদ প্রকাশ গুটি শহীদ প্রকাশ বাবা শহীদ প্রকাশ ইয়াবা শহীদ।  আর এতে সহায়তা করতো আকবরশাহ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও জলিল মিস্ত্রি বাড়ির জুয়েল সিদ্দিকী প্রকাশ মেন্টাল জুয়েল ও অপর যুবকেরা।  বিভিন্ন সময় এই মেয়েকে শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটেছে।  এই বিষয়ে প্রতিবাদ করে রনি।  তার বোনকে মেম্বার শহীদ ও ইয়াবা শহীদের কাছে বিয়ে দিতে নানান ধরণের চাপ প্রয়োগ করা হতো।  রেশমীকে আসা-যাওয়ার পথে নানান মানহানিকর মন্তব্য করতো, গায়ে হাত দিতো, তুলে নিতে চাই উল্লেখিতরা।  শুধু রেশমী নয়, এলাকার অনেক মেয়ের সাথেই এমন করতো তারা।  রেশমী বিবাহিত, সে কেন আবার বিয়ে করবে- এমনটি জানালেও মেম্বার শহীদ, ইয়াবা শহীদ, জুয়েলসহ অনেকেই তাকে উত্যক্ত করতো সব সময়।

নিহতের পরিবারের ভাষ্যমতে, জলিল মিস্ত্রী বাড়ির জুয়েল সিদ্দিকী, স্থানীয় জব্বার আলী সারেং বাড়ির বদিউল আলম প্রকাশ লেদুর ছেলে মো. শহীদ, ফতেহ আহমদ চৌধুরীর নতুন বাড়ির মৃত আব্দুল মান্নান প্রকাশ মন্নাইয়ার ছেলে মো. শহীদসহ বেশ কয়েকজন যুবক নিয়মিতভাবেই ওই এলাকায় আড্ডা দিতো।  মাদকের সাথেও তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।  তারা দীর্ঘদিন ধরে রেশমীকে কু-প্রস্তাব দেয়া ছাড়াও শহীদকে বিয়ে করতে চাপ দিচ্ছিল।  এসবের প্রতিবাদ করেছে ভাই শহীদুর রহমান রনি।  এতে ক্ষীপ্ত হয়ে সর্বশেষ সোমবার (২৭ জুলাই) রাতে রনিকে তুলে নিয়ে যায় শহীদ ও তার সহযোগিরা।  এতে সরাসরি সঙ্গ দেয় জুয়েল সিদ্দীকিসহ অন্যান্যরা।  সারারাত তাকে আটকে রেখে মারধর করা হয় তাদের সাথে বেয়াদপি করায় এবং যেন সে তার বোনকে তাদের প্রস্তাবে রাজি করায়।  এ দিন রাতে রনি ঘরে না ফেরায় পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনেরা খোঁজাখুঁজি করেন।  পরের দিন মঙ্গলবার (২৮ জুলাই) ভোরে রনি অনেকটা ক্লান্ত হয়ে উলঙ্গ অবস্থায় ফেরেন।  নিজ ঘরে না গিয়ে রনি প্রতিবেশী সিরাজ ড্রাইভারের ঘরে যায়।  তাকে সবকিছু খুলে বলে।  তবে রনি ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল সিদ্দীকি, মো. শহীদসহ তার ছেলেদের কিরিচ, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়া ও হত্যার হুমকি দেয়ার কথা জানান প্রতিবেশি সিরাজকে।  সারাদিনই সে আতঙ্কে ছিল।  পরিবারও খবর পেয়ে ছুটে আসে এবং রনির কাছ থেকে রাতের ঘটনা শোনেন।  পরে সকাল ১০ টায় তার মা-বোন ও পরিবারের সদস্যরা আকবরশাহ থানায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মামলা করতে যান।  পরিবারের অভিযোগ- পুলিশ থানা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ অন্যান্যদের নাম-পরিচয় জেনে মামলা নিতে গরিমসি করে।  তাদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করেন।  তারা আসামি শহীদুলকে ‘শহীদুল ভাই’ সম্বোধন করে বলছিলেন থানায় মামলা হবে না।  তাদের সাথে বসে যেন সমাধান করে ফেলে।  যখন রেশমী ও তার পরিবার তাদের মামলা নিতে বারংবার অনুরোধ করে তখন বলা হয় কোর্টে গিয়ে মামলা করতে।  থানায় হবে না।  এরপর তারা দুপুরে থানা থেকে কোর্টে যান এবং আইনজীবীর সাথে কথা বলেন।  কোর্টে মামলা নেয়ার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আইনজীবীর পরামর্শ মতে সিএমপি পুলিশ কমিশনারের অফিসেও যান।  সেখান থেকে ডিবি কর্মকর্তাদের কাছে পাঠালে তারা বিষয়টি দেখবেন বলে জানান।  পুরো পরিবার সারাদিন এভাবেই দ্বারে দ্বারে যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করতে।  বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে তারা ঘরে ফেরেন। নিজেরা পরিচ্ছন্ন হয়ে রান্না করে রাতে রনি ও ছোট ভাই রায়হানের জন্য খাবার নিয়ে যান। রাত সাড়ে আটটার দিকে যখন তারা রনির কলোনীতে যান তখন রনির সাড়া শব্দ না পেয়ে ধারণা করেন সে হয়তো ঘুমাচ্ছে।  রাত পৌনে ন’টার দিকে রনির ঘরের দরজায় টোকা দিলে দরজা খোলা পাওয়া যায়। তখন্তই কে দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান রেশমা।  সাথে সাথেই তার চিৎকারে আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়।  এরপর খবর পাওয়ারও দেড় ঘন্টা পর আকবরশাহ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মোস্তাফিজুর রহমানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন।
নিহত রনির বোন রেশমী আক্তার দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, আকবরশাহ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল সিদ্দীকির সরাসরি সহযোগিতায় বখাটে শহীদ, স্থানীয় খোকনের ভাই শহীদসহ আরো এক যুবক আমার ভাইকে সারারাত আটকে রেখে মারধর করেছে।  তারা অনেকদিন ধরে আমাকে কু-প্রস্তাব দিয়ে আসছিল।  সর্বশেষ আমার ভাইকে আটকে রেখে মারধরের ঘটনা ও আমাকে কু-প্রস্তাব দেয়ার অভিযোগ জানাতে মঙ্গলবার সকালের দিকে আকবরশাহ থানায় যাই।  কিন্তু থানা পুলিশ আমাদের মামলা নিতে গরিমসি করে, মামলা নেয়নি।  খারাপ ব্যবহারও করে।  তিনি বলেন, আমার ভাই সারাদিনই ভয়ে ছিল।  জুয়েল সিদ্দীকি, শহীদ তাদের ছেলেদের নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়েছে।  আমরা সবাই সারাদিন থানা-কোর্ট-পুলিশ কমিশনার কার্যালয়-ডিবি অফিসে আইনী সহযোগিতা পেতে দৌড়াদৌড়িতে ছিলাম।  একা পেয়ে আমার ভাইকে তারা হত্যা করে দড়িতে ঝুলিয়ে দিছে।  আমার ভাইয়ের পায়ে জখমের চিহ্ন আছে।  তার দুই পা যে অবস্থায় ছিল তাতে কোনোদিন ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার মতো বোঝাবে না।  আর আমার ভাই আত্মহত্যা করার মতো সাহসও নেই।  যে ওড়নাটায় ঝুলানো ছিল সেটিও আমাদের কারো না।  আমার ভাইয়ের সাথে কি হয়েছে আমি আন্দাজ করতে পারছি।  তিনি বলেন, আমি বিবাহিত, আমাকে কিছুদিনের মধ্যে শ্বশুরবাড়িতে তুলে নেয়ার কথা।  আমি কি করে আবার বিয়ে করবো?  তারা বিভিন্ন সময় আমাকে কু-প্রস্তাব দিয়েছে।  এই মেম্বার শহীদ, ইয়াবা শহীদ ও জুয়েলরা এরকমই করে।  এলাকার আরো অনেক মেয়েকেও তারা বিরক্ত করে।  আমরা এই চারজনসহ আরো কয়েকজনকে সন্দেহ করছি।  তারা এখন এলাকায় নেই।
প্রতিবেশি মো. সিরাজ দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, সোমবার রাতে রনি যখন ঘরে আসেনি সবাই চিন্তায় ছিল।  পরেরদিন ভোরে (মঙ্গলবার) রনি ফিরে আসে একেবারে উলঙ্গ অবস্থায় এবং আমার ঘরে বসে।  সে কিছু নিয়ে ভয়ে ছিল।  ক্লান্ত ছিল।  তার পায়ে মারের দাগ ছিল।  সে আমাকে সব ঘটনা বলে।  পরে আমি তাকে বিশ্রাম নিতে বলি।  এরপর আমি কাজে চলে যাই।  রাতে এসে শুনি সে মারা গেছে।
তবে স্থানীয়দের অনেকে জানান, নিহত শহীদুর রনি মাদকসেবী ছিল। এই বিষয়টি ছাড়া তার কোনো খারাপ রেকর্ড নেই।  অন্যদিকে, আকবরশাহ থানা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. জুয়েল সিদ্দিকীর বিরুদ্ধেও মাদকের আখড়া থেকে চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্যক্ত করা, জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে।  বিবাহিত জুয়েল সিদ্দীকি জমি দখলে সহযোগিতা, মাদক বিক্রেতাকে বাঁচাতে গিয়ে গণপিটুনিরও শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে।  অভিযুক্ত শহীদসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধেও বখাটেপনা করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

আকবরশাহ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল সিদ্দীকি দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, ‘আমি রাজনীতি করি।  আমার বিপক্ষের কিছু মানুষ ষড়যন্ত্র করছে।  যে পরিবার আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তাদের নিয়েও এলাকায় খারাপ গুঞ্জন আছে।  আমি চাঁদাবাজি করি না।  বরং মাদকের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমি কিছু প্রতিবাদ করেছিলাম।  সে জন্য কিছু শত্রু তৈরি হয়েছে’।  অনেকেইতো রাজনীতি করে, আপনার বিরুদ্ধে কেন এতো অভিযোগ- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এসবের সাথে জড়িত না।  থানায় মামলা হয়েছে।  তদন্ত হোক।  তখন যদি আমি অপরাধী প্রমাণিত হই যা হবে তাই মেনে নিবো।

এই বিষয়ে জানতে আকবরশাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে বুধবার বিকেলে ফোন করা হলে তিনি দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, মঙ্গলবার বেলা ১১ টায় রেশমী আক্তারসহ তার ভাই থানায় গিয়েছিল মামলা করতে। দুপুর দেড়টায় আমরা মামল রেকর্ড করি।  থানায় কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করার কোনো সুযোগই নেই।  সেখানে সিসি ক্যামেরা আছে।  কেউ এমন করলে তা ধরা পড়বে।  এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা সকালে যে অভিযোগে মামলা করতে গিয়েছিল সেখানে শহীদ নামে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিল আমরা সেটা গ্রহণ করেছি।  তখন জুয়েল সিদ্দীকির বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করেনি।  এরপর রাতে যখন আমরা খবর পাই তার ভাই (শহীদুর রনি) মারা গেছে, তখন আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছি।  আমাদের ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিক সুরতহাল প্রতিবেদন শেষে তার ময়না তদন্ত করতে লাশ মর্গে প্রেরণ করেছি।  তার গলায় দাগ দেখা গেছে।  তবে এটি আত্মহত্যা নাকি হত্যা তা ময়না তদন্ত শেষে বলতে পারবো।
এই ঘটনায় মামলা হয়েছে জানিয়ে ওসি বলেন, আজ (বুধবার) ভোরে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে নিহতের পরিবার। সেখানে জুয়েল সিদ্দীকি, মো. শহীদ নামের দুইজন এবং তানজিল- এই ৪ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে।  আমরা তদন্ত করছি।  ময়না তদন্তের প্রতিবেদন পেলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।

ডিসি/এসআইকে/আইএস