সাংবাদিকদের ‌‘সায়েস্তা’ করতে তুলে নেয়া হয় সারওয়ারকে, যা বললেন সারওয়ার

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
‘অপহৃত’ সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার দাবি করেছেন তিনি অপহরণকারীদের মূল টার্গেট ছিলেন না।  মূলত চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক সমাজকে ‘সায়েস্তা’ করতেই তাঁকে তুলে নেয়া হয়েছিলো।
প্রায় চারদিন নিখোঁজ থাকার পর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরার একটি খালের পাড় থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার হন রবিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে।  প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় বিধ্বস্ত গোলাম সারওয়ারকে।  এর একদিন পর আজ সোমবার (২ নভেম্বর) সাংবাদিকদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করেন তিনি।
গোলাম সারওয়ার সাংবাদিকদের জানান, অজ্ঞাত স্থানে বন্দি থাকা অবস্থায় আমি বেশ কয়েকবার অপহরকারীদের কথোপকথন শুনতে পেয়েছি।  অপহরণকারীরা কেউ একজনকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে করে কথা বলছিলো।  এসময় আমি শুনতে পাই অপহরণকারীরা মোবাইলের অপর প্রান্তের লোককে বলছিলেন, ‘স্যার ফেলে দেব কিনা’।  কিন্তু ওই ব্যক্তি জবাবে বলেন, ‘না না … ও হলো ত্যানাফাডা (ছোটখাটো) সাংবাদিক, ওকে ফেলে লাভ নেই।  ওকে দিয়ে অন্যদের সায়েস্তা করবো।  সাংবাদিকদের এখন আর বেইল (মূল্য) নাই’।
অপহরণের সময়কার ঘটনার বিবরণ দিয়ে সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘অপহরণের দিন (বৃহস্পতিবার) আনুমানিক রাত ১২ টার দিকে নগরের জিইসি মোড় এলাকা হয়ে বাড়ি (চন্দনাইশ) যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।  আলমাস সিনেমার একটু আগে একটি ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেলকে হাত দেখাই।  এসময় চালক কোথায় যাবো জানতে চাইলে আমি বলি- ‌‘নতুন ব্রিজ (শাহ আমানত সেতু) যাবো’।  কিন্তু মোটর সাইকেলে কিছুদুর যেতেই চালক গাড়িটি ধীর করার সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে এক ব্যক্তি মোটর সাইকেলে উঠে বসেন।  আমি বিষয়টির প্রতিবাদ করলে ওই ব্যক্তি চুপ থাকার আদেশ দিয়ে পেছন দিক থেকে দ্রুত আমার মুখমণ্ডলে কিছু একটা ঘষে দেন।  সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখও বেঁধে ফেলা হয়।  এরপর আমি আর কিছু বুঝতে পারছিলাম না’।
সারওয়ার বলেন, ‘এর অনেক্ষণ পরে আমি অনুভব করলাম আমি একটি অ্যাম্বুলেন্সে চড়ছি।  এর আরো বেশ কিছুক্ষণ পরে নিজেকে একটি মেঝেতে আবিস্কার করি’।
এসময় সারওয়ার তার অবস্থানের কাছাকাছি কোথাও ট্রেন যাতায়াতের শব্দ শুনতে পান জানিয়ে সরওয়ার বলেন, অপহরণকারীরা এসময় আমাকে কিছু একটা দিয়ে পেঁচিয়ে চট্টগ্রামের ভাষায় জানতে চান- ‘আর নিউজ গরিবিনা হ (আর নিউজ করবি কিনা বল)।
সারওয়ারের দাবি এসময় অপহরণকারীরা চারজন ছিলো, যার একজন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন।  বাকিরা ঢাকা এলাকার বাসিন্দা।  এসময় তাকে লোহার রড, লাঠি দিয়ে মারধর করা হয়।
গতকাল রবিবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬ টার পর স্থানীয়রা সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী একটি খালের পাশের ঝোপঝাড় থেকে গোলাম সারওয়ারকে উদ্ধার করে।  এ সময় গোলাম সারওয়ারের পরনে একটি গেঞ্জি ও অন্তর্বাস ছাড়া আর কিছুই ছিল না।  এরপর স্থানীয়রা সীতাকুণ্ড থানা ও সাংবাদিকদের খবর দেন।  সন্ধ্যা ৭ টার দিকে সীতাকুণ্ড পুলিশ তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।  পরে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের একটি টীম (কতোয়ালী থানাসহ) ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ তাকে সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।  এরপর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে), বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) নেতৃবৃন্দ, নগর পুলিশ কমিশনারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে দেখতে হাসপাতালে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উদ্ধা‌রের সময় গোলাম সারওয়ারের গা‌য়ে সে‌ন্ডো গে‌ঞ্জি ও পর‌নে ছিল শুধু আন্ডারওয়্যার।  স্থানীয় লোকজন উদ্ধার ক‌রে তা‌কে নি‌য়ে যান এক‌টি ডেকোরেটরের দোকানে।  সেখা‌নে তা‌কে দোকা‌নের ফ্লো‌রে অ‌চেতন অবস্থায় শুই‌য়ে রাখা হয়।  ডেকোরেশনের কাপড় দিয়ে তার দেহ ঢেকে দেয়া হয়।  সেখা‌নে জ‌ড়ো হন অনেক লোক।  হা‌জির হন পু‌লিশ, গণমাধ্যমকর্মীসহ অ‌নে‌কে। এক পর্যা‌য়ে গোলাম সারওয়ারকে স্থানীয় হাসপাতা‌লে নেয়ার জন্য চেষ্টা কর‌ছিল স্থানীয় লোকজন।  এ সময় সারাওয়ারন সবার পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে শুধু বলতে থাকেন, ‘ভাই, আমারে মাইরেন না।  আমি আর নিউজ করব না’।
৭ নম্বর কুমিরা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন জানান, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে খাল পাড়ে ফেলে দিতে দেখে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করে রাস্তার পাশে ডেকোরেশনের দোকানে রাখেন।  তখন তিনি কিছুটা কথা বলতে পারছিলেন।
স্থানীয় ওই ডেকোরেশনের মালিক বাবু বলেন, ‘আমি প্রস্রাব করতে খাল পাড়ে গেছিলাম।  এ সময় পাশের ঝোপঝাড় থেকে আওয়াজ শুনছিলাম- ‘ভাই আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান।’ তখন আমি একা থাকায় সেদিকে যাইনি।  দ্রুত দোকানে এসে আমার বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে সেখানে গিয়ে সাংবাদিককে উদ্ধার করি’।
অপহরকারী কর্তৃক সাংবাদিকদের সায়েস্তা করার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ বলেন, ‘পুরো ঘটনাকে আমরা সাংবাদিকদের জন্য হুমকি হিসেবেই নিচ্ছি।  কিন্তু একারণে আমাদের কলম বন্ধ হয়ে যাবে না।  আমরা চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতি দ্রুত এই ঘটনার সাথে জড়িতদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনুক।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘সাংবাদিক সারওয়ারের অপহরণের বিষয়ে যে বা যারা জড়িত থাকবে তাদের আইনের আওতায় আনতে যা যা করণীয় সব করা হবে।  এ বিষয়টি আরও তদন্তের বিষয় আছে’।
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, সারওয়ারকে আমরা ফিরে পেয়েছি সে জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ শুক্রিয়া জানাচ্ছি।  সেই সাথে আমরা উদ্বিগ্ন এই কারণে যে- সাংবাদিকদের সায়েস্তা করতে, ভয় দেখাতে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।  সারওয়ারকে নির্দয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।  চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন সর্বস্তরের সংবাদকর্মীদের সুরক্ষাকল্পে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
এর আগে গত ২৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) সকালে চট্টগ্রাম নগরীর ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের আর খোঁজ মিলছিল না।  এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তার পরিবার সহকর্মীরা।  চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে) জোড়ালো আন্দোলন শুরু করে।  সর্বশেষ রবিবার (১ নভেম্বর) বেলা ১১ টা থেকে দুপুর পর্যন্ত সিএমপি কমিশনারের অফিসের সামনে অবস্থান কর্মসূচি এবং কর্মসূচি শেষে সিএমপি কমিশনারের সাথে দেখা করে রবিবারের মধ্যে সারওয়ারকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা না হলে কঠোর আন্দোলনের বার্তা দেন।  এর ৬ ঘন্টার মধ্যেই সারওয়ারের খোঁজ পাওয়ার তথ্য জানা যায়।  গোলাম সারওয়ার সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের স্টাফ রিপোর্টার এবং সিটিনিউজ নামের একটি অনলাইন পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদক।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ