রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোবাইল নেটওয়ার্ক : তিন বছরে ৭৩১ মামলা

ছবি- ইন্টারনেট থেকে।

কক্সবাজার প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
বাংলাদেশের জন্য ক্রমেই আতঙ্কের নাম হতে যাচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।  দিনকে দিন তাদের অপরাধ, সংগঠিত হওয়ার মাত্রা এবং নিজেদের অস্তিত্ব, আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে নানানভাবে অবৈধভাবে সংঘবদ্ধ গ্রুপে পরিণত হচ্ছে তারা।  তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এতোটাই ভয়াবহ যে, এ নিয়ে দেশে বিশেষত কক্সবাজারে আতঙ্ক বিরাজ করছে।  বিশেষত মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু থাকায় এর সুবিধা নিচ্ছে তারা।  অবৈধ নানান কর্মকাণ্ড আর অপরাধে ব্যবহার করছে এই সুযোগ।  এতে যুক্ত হয়েছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ মোবাইল নেটওয়ার্কও।  দেশটির সরকার তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা এতোটাই শক্তিশালী করেছে যে, তাদের সেই নেটওয়ার্ক মিয়ানমার সীমান্ত থেকে টেকনাফ-উখিয়া উপজেলার ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে।  বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের এই মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ইন্টারনেট ও আনরেজিস্ট্রার্ড মোবাইল সীম ব্যবহার করে নানান অপরাধ সংঘটিত করছে।  গত তিন বছরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মোট ৭৩১টি মামলা হয়েছে নানান অপরাধে।  এই তথ্যটি হালনাগাদ করলে এর সংখ্যাগত তথ্যটি কয়েকগুণ বাড়বে বলে জানান নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ৩ বছর পূর্ণ হয়েছে।  গত ৩ বছরে ৭৩১টি মামলায় ১ হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে।  এসব মামলার মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪১০টি মামলা হলো ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা।  এছাড়া হত্যা মামলা হয়েছে ৫৩টি।  ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৩৫টি। অস্ত্র মামলা হয়েছে ৫৯টি।  অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ফরেনার্স এ্যাক্টে মামলা হয়েছে ৩৮টি।  মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ২৮টি।  বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে ২৬টি।  অপহরণ মামলা হয়েছে ১৬টি।  ডাকাতির অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০টি।  পুলিশের কাজে বাঁধা দেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৩টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ৫৩টি।  মামলা সংক্রান্ত এই তথ্য হালনাগাদ হলে আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর থ্রিজি এবং ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করতে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল বিটিআরসি।  বাংলাদেশী নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকাকালীন মিয়ানমারের শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান করছিলেন আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দারা।

ছবি- ইন্টারনেট থেকে নেয়া।

জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবির থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত ১০ কিলোমিটার থেকে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।  সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করেছে।  এতে রোহিঙ্গারা অনায়াসে মিয়ানমারের মোবাইল সিম ব্যবহার করতে পারছেন।  আর ক্যাম্পে বসেই তারা ভয়েস ও ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।  পাশাপাশি বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের সিমও ব্যবহার করছেন তারা।  সংশ্লিষ্টরা জানান, আশ্রয় শিবিরগুলোতে থাকা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা ৮ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহার করছেন।  এর মধ্যে অর্ধেক সিম রয়েছে মিয়ানমারের।  বাকি অর্ধেক ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের।
তবে সব সিম অবৈধ বলে মন্তব্য করেছিলো বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন।  রোহিঙ্গারা কি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অপারেটরদের সিম ব্যবহার করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।  তারা জানান, দেশের বৈধ নাগরিকরাও যেখানে বায়োমেট্রিক ছাড়া সিম ব্যবহার করতে পারেন না, সেখানে রোহিঙ্গারা অনায়াসেই আমাদের সিম ব্যবহার করছে।  এটি আইন বহির্ভূত একটি কাজ।  নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিও বিষয়টিকে সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছে।
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর্স অব বাংলাদেশ জানিয়েছে, বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও তৎসংলগ্ন এলাকায় থ্রি-জি ও ফোর-জি সেবা পুনরায় চালু করা হয়েছে।  এ নিয়ে অপারেটরদের আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠিয়েছে বিটিআরসি।
বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী সচিব আব্দুল্লাহ আল আমীন স্বাক্ষরিত ওই চিঠি পাঠানো হয় গত ২৮ আগস্ট। বিটিআরসির সমালোচনা করে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন বলেছে- এক বছর বন্ধ থাকার পর পুনরায় উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় থ্রি-জি ও ফোর-জি নেটওয়ার্ক পুনরায় চালু করে দেয়া হয়।  রোহিঙ্গাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের বিপক্ষে আমরা নই।  তবে যে প্রক্রিয়ায় ও যুক্তি তুলে ধরে ইন্টারনেট চালু করা হয়েছে আমরা তা মানতে নারাজ।
সর্বপ্রথম যখন ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল সেই সময় সাবেক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী তারানা হালিম স্বয়ং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে শুধু টেলিটক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বুথ থেকে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।  কি কারণে তা বন্ধ করা হলো তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।  এরপর রোহিঙ্গারা যখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে জনসমাগম করলো তখন বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হলো।
আমরা বলতে চাই নেটওয়ার্ক বন্ধ করার পর বিটিআরসির একটি কমিটি উখিয়া ক্যাম্প পরিদর্শন করে।  সেই সময় আমরাও বলেছিলাম মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক দেশের অভ্যন্তরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।  বিটিআরসি আইন অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যে বৈঠক করে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক বন্ধ করতে পারে।  কিন্তু তারা সে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।  তাই বিটিআরসি এর দায়ভার এড়াতে পারে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আশ্রয় ক্যাম্পে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করছেন রোহিঙ্গারা।  সিমের পাশাপাশি তারা ব্যবহার করছেন ইন্টারনেট সেবাও।  এর মাধ্যমে গ্রুপ চ্যাটিং করে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করছেন নিয়মিত।  এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে এক জায়গায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার জনসমাবেশ হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।  আর এসব সম্ভব হচ্ছে মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে।  নিয়ম অনুযায়ী কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সিম ব্যবহার করতে পারেন না।  কারণ সিম কিনতে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি লাগে।  তার ওপর রয়েছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন গণমাধ্যমকে জানায়, রোহিঙ্গাদের হাতে সিম ইস্যুতে সবাই যেভাবে দায়িত্ব এড়াতে চাচ্ছেন তা অত্যন্ত হাস্যকর।  আগে ওই এলাকায় মোবাইল সিমের ব্যবহারকারী কতজন ছিল আর এখন কতজন হয়েছে সে হিসাবটা বের করলেই খুব সহজেই বিষয়টি বোঝা যাবে।  পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত এক কিলোমিটারের মধ্যে ৫০ টির বেশি পরিবার থাকে না।  সে হিসাবে তাদের হাতে কয়টা সিম থাকতে পারে আর এখন কতটা আছে?
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে একেকটা সিম ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকার বিনিময়ে কিনছেন রোহিঙ্গারা।  বিশেষ করে কর্পোরেট সিম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন রোহিঙ্গারা।  এই সিম একজনের নামে অনেকগুলো দেয়ার সুযোগ রয়েছে।  এটাই কাজে লাগাচ্ছেন অসাধুরা।  বাড়তি টাকার বিনিময়ে ওইসব সিম তুলে দিচ্ছেন রোহিঙ্গাদের হাতে।  তারা জানান, এখন রোহিঙ্গাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে।  মুহূর্তের মধ্যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সমবেত হতে পারে।  অদূর ভবিষ্যতে তারা যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে?  এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু।  সরকার বা বিটিআরসি যদি এখনই কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে এর জন্য যে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে তার দায়ভার কে নেবে?
দীর্ঘদিন পর গত ২৮ আগস্ট পুনরায় থ্রিজি এবং ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু করেছে মোবাইল অপারেটরগুলো।  এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটার চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, বিটিআরসির নির্দেশনা পেয়ে আমরা পুনরায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় থ্রিজি ও ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু করি।
এদিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু’র পরপরই গত আগস্ট মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন-খারাবি শুরু হয়৷  এ সময় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মোবাইলে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্যাম্পে গুজব ছড়ায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা৷  এই ঘটনায় ৯ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ নিহত হয়।  এসময় প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের হাতে আহত হন শতাধিক রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যত অপরাধ কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে সব মোবাইল নেটওয়ার্ক এর কারনে।  রোহিঙ্গাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার যতদিন বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ততোদিন অপরাধ কমবে না।

ডিসি/এসআইকে/এমএস