আকবরশাহ’র আতঙ্ক কে এই নুরু, ২৮ মামলার এই আসামির পৃষ্ঠপোষক কারা?

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম জেলার গুনবতী থানার চাঁপাচো হাজি বাড়ির তনু মিয়া ভাণ্ডারির ছেলে নুর আলম প্রকাশ নুরু।  আকবরশাহ থানাধীন সরকারি পাহাড়ে দখল-সাম্রাজ্য গড়ে তোলা এই নুরু বললেই চুপসে যান স্থানীয়রা।  মুখ খুলতে চান না কেউই।  আকবরশাহ থানার পূর্ব ফিরোজশাহ ১ নম্বর ঝিল এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক নুরু।  সরকারি পাহাড় দখল, কাঠ পাচার, অস্ত্রবাজি, পাহাড় কাটা, চুরি, ডাকাতিসহ অনেক কাজের কাজী নুুরে আলম নুরু।  সর্বশেষ পুলিশের উপর হামলার পর থেকে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।  নানা অপরাধে নুরুর বিরুদ্ধে নগরীর আকবরশাহ ও খুলশী থানায় দায়ের করা মামলার সংখ্যা ২৮টি।  এরমধ্যে অস্ত্র আইনের একটি মামলায় ২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট তার বিরুদ্ধে ১৭ বছর সাজার আদেশ হলেও সেই সাজা পরোয়ানা থানার নথিতেই নেই!
গত ২৬ ডিসেম্বর (শনিবার) বিকেলে আকবরশাহ থানার ১ নম্বর ঝিল এলাকায় সন্ত্রাসী নুরুকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় পুলিশ।  এ সময় সন্ত্রাসীদের অতর্কিত আক্রমণে সেখান থেকে ফিরে আসেন পুলিশ সদস্যরা।  ওই সময় পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।  উভয় পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনাও ঘটে বলে খবর পাওয়া যায়।
সেই ঘটনার পাঁচদিনের মাথায় গত ৩১ ডিসেম্বর আবারও ১ নম্বর ঝিলে অভিযান চালিয়ে যে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেন বিউটি আক্তার (২৭), মো. মোশারফ হোসেন (২২), মো. পারভেজ (২৮), মো. ওমর আলী (৩০), মো. জুয়েল রানা (১৯), মো. রাসেল (২৮), মো. বাবুল (২৮), আতাউল্লাহ (২৬), মো. সাঈদ (২০), মো. হৃদয় হোসেন (১৯), মো. ইব্রাহীম খলিল (৩০) ও অহিদুল ইসলাম বাদশা (১৯)।
এর মধ্যে মো. ওমর আলী (৩০), মো. জুয়েল রানা (১৯), মো. রাসেল (২৮), মো. বাবুল (২৮), আতাউল্লাহ (২৬),মো. হৃদয় হোসেন (১৯) ও অহিদুল ইসলাম বাদশা (১৯) গত ২৬ ডিসেম্বর পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার এজহারভুক্ত আসামি বলে থানা সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

২৬ ডিসেম্বর পুলিশের উপর হামলার পর ৩১ ডিসেম্বর পুলিশের অভিযানে অস্ত্রসহ আটক ১১ সন্ত্রাসী।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে- স্থানীয় বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সহায়তায় সংশ্লিষ্ট থানার এবং আদালতের সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তা-কর্ম চারীদের ম্যানেজ করে সাজা পরোয়ানা গায়েব করেছে নুরু।
তবে, পুলিশের দাবি- নুরুর বিরুদ্ধে ১৭ বছরের সাজা হয়েছে- এ ধরণের কোনো পরোয়ানা বিগত দুই বছরে থানায় আসেনি।
অথচ সাজা পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পূর্ব ফিরোজশাহ নাছিয়াঘোনা এলাকায় সরকারি পাহাড় দখল করে নুরু গড়ে তুলেছে নিজস্ব সাম্রাজ্য।  সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৬ জুলাই রাত তিনটা দশ মিনিটে আকবরশাহ থানার ফিরোজ শাহ কলোনির ওবেট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছন থেকে নুরুকে আটক করে পুলিশ।  এ সময় তার কোমরে লুঙ্গির সাথে পেঁচানো অবস্থায় একটি দেশে তৈরি এলজি ও এক রাউন্ড কার্তুজ পাওয়া যায়।  অভিযানকালে তার সাথে থাকা আরো কয়েকজন পালিয়ে গেলেও সঙ্গীদের ফেলে যাওয়া একটি দেশে তৈরি বন্দুক ও আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এই মামলায় নুরুর ১৭ বছরের সাজানোর রায় হয়।
অভিযোগ আছে, সাজাপ্রাপ্ত নুরু আকরবশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেনের ছত্রচ্ছায়ায় তার অপরাধ কর্ম করে থাকে।  সরকারি পাহাড় কেটে তা বিক্রি করে যে অর্থ নুরু পায় তার একটি অংশ পান কাজী আলতাফ।  শুধু তাই নয়, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আওয়ামী ঘরানার একজন সাবেক জনপ্রতিনিধিও তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন।  বিনিময়ে তিনিও নুরুর কাছ থেকে সরকারি পাহাড় দখল-বাণিজ্যের বড় একটি অংশ পান।  আবার নিজেও সরকারি পাহাড় কেটে দখল, বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে, মামলার প্যাঁচে ফেলে হাতিয়ে নেয়া পাহাড়ি জায়গা কাটা, দখল নেয়া, স্থাপনা তৈরির সময় এই নুরু ও তার সহযোগিদের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন।  শুধু আওয়ামী লীগের নেতারাই নন, নুরুকে বশে রাখেন বিএনপির দু’একজন নেতাও।  বলা চলে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় নেতাদের সন্ত্রাসী নুরু পকেটেই রাখেন।  সবার সাথে সখ্যতা রেখে, সমন্বয় করে নুরু তার অপরাধের সাম্রাজ্য গড়েছে- এমনটাই জানান স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি।

সন্ত্রাসী কাজী নুরে আলম নুরুকে বেশ কাছে টেনে কথা বলছেন আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেন।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেনের সাথে সন্ত্রাসী নুরু বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যেতো।  এরই মধ্যেই নুরুর সাথে বেশ ঘণিষ্ঠ অবস্থায় একটি ছবি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ পেয়েছে।  অনুষ্ঠানের মঞ্চে নুরুর সাথে ঘনিষ্ঠ ছবি থাকা প্রসঙ্গে আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নুরু বিএনপির সমর্থক।  বিএনপির লোক আওয়ামী লীগ সভাপতির অনুসারী হতে পারে না।  তার সাথে আমার চার/পাঁচ বছর আগে একবার দেখা হয়েছে।  তবে ঘনিষ্ঠতা নেই।  ওই ধরনের কোনো ছবি থাকলে কেউ হয়তো ষড়ষন্ত্র করছে’।
নুরুর সাথে সম্পর্কতো দূরের কথা যোগাযোগও নেই বলে জানান কাজী আলতাফ।  তিনি স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, ‘সরকারি পাহাড় দখল, পাহাড় কাটা, চুরি, ডাকাতি এমন কোনো কাজ নেই নুরু করে না।  আমরা পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করি।  কোনো ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত নই।  আমার কারণে যাদের সমস্যা হচ্ছে তারা আমার বিরুদ্ধে এ বদনাম ছড়াচ্ছে’।
সাজার কথা জানে না পুলিশ
নগর পুলিশের পশ্চিম জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হুমায়ন কবির জানান, নুরুর বিরুদ্ধে ১৭ বছরের সাজা পরোয়ানার বিজ্ঞ আদালতের আদেশের কপি আমাদের থানায় আসেনি।
অন্যদিকে, দুই বছরেও সাজা পারোয়ানা থানায় না পৌঁছায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন।  তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী যে আদালত সাজা দিয়েছে সেই আদালত থেকে সাজা পরোয়ানা দণ্ডিত আসামি যে থানা এলাকায় থাকেন সেই থানায় যাবে।  দুইশো বছর ধরে এটাই হয়ে আসছে।  কিন্তু থানা বলছে একজন আসামির ১৭ বছরের সাজা পরোয়ানা তাদের কাছে নেই।  বিষয়টি তদন্ত করে দেখার প্রয়োজন আছে।
নুরু যে মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছে সেই মামলার রায়ের আদেশে বলা হয়েছে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম জেলার গুনবতী থানার চাঁপাচো হাজি বাড়ির তনু মিয়া ভাণ্ডারির ছেলে নুর আলম প্রকাশ নুরু বর্তমানে নগরীর আকবরশাহ থানার পুর্ব ফিরোজশাহ ১ নম্বর ঝিল এলাকায় থাকেন।  তাকে অস্ত্র আইন ১৮৭৮ এর ১৯ এ ধারায় ১০ বছর সশ্রম ও ১৯ (এফ) ধারায় ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।  পলাতক আসামি নুরু যে দিন আদালতে হাজির হবেন কিংবা পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন সেদিন থেকে তার সাজার মেয়াদ গণনা করা হবে।  তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাসহ সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হোক।
২০১৪ সালে এসআই সেলিম মিয়া বাদি হয়ে অস্ত্র আইনে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।  ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট তার বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মনির হোসেন।  এ ব্যাপারে ১০ ব্যক্তি আদালতে স্বাক্ষী দেন।  অবৈধ অস্ত্র ও গুলি রাখার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই নুরুর বিরুদ্ধে ১৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন মহানগর বিশেষ ট্রাইবুনালের বিচারক মুহাম্মদ ছালামত উল্লাহ।

ডিসি/এসআইকে/সিসি