নগর প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
‘বিএনপি তখন ক্ষমতায়। জামায়াত-শিবির তাদের লালিত-পালিত। ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। আমি ফটিকছড়ি গিয়েছিলাম ছাত্রলীগের সম্মেলনে। আমার সঙ্গে প্রয়াত নেতা ফটিকছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারও ছিলেন। সম্মেলন চলছিল, দুপুর ১ টার দিকে হঠাৎ শিবিরের একটি সশস্ত্র বাহিনী ট্রাকে-বাসে এসে আক্রমণ চালায়। সেখানে আমাদের ছাত্রলীগ কর্মী জমির উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে। চারদিকে ছোটাছুটি শুরু হলে আমি এবং রফিকুল আনোয়ার পার্শ্ববর্তী স্কুলের অফিসে আশ্রয় নিই। দেখলাম, পুলিশের সামনে দিয়ে ট্রাকে-বাসে করে অস্ত্র হাতে নিয়ে শিবিরের সন্ত্রাসীরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে যাচ্ছে’।
মঙ্গলবার (৯ মার্চ) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ১৯৯২ সালের ৮ মে সংঘটিত এই ঘটনার বিবরণ তিনি এ সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলন থেকে ঘটনার ১ নম্বর আসামি শিবিরের সাবেক ক্যাডার নাসির উদ্দিনের ফাঁসির পাশাপাশি তার পৃষ্ঠপোষক ও নির্দেশদাতাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন তিনি। দীর্ঘ ২৯ বছরেও এ ঘটনার বিচারকাজ সমাপ্ত না হওয়ায় বিষ্ময় প্রকাশ করেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ।
গত ১ মার্চ চট্টগ্রামের একটি দৈনিকে সাক্ষী না আসায় ‘ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ওপর হামলা ও হত্যাকা-ের’ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা বিলম্বিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এর প্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান পরিস্কার করতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন মোশাররফ।
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সেদিন হামলার ঘটনায় নিহত জমিরের জানাজা পড়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। আমি ভেবেছিলাম, হাটহাজারী হয়ে গেলে আমাদের ওপর শিবিরের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করতে পারে। তখন রুট পরিবর্তন করে ফটিকছড়ির নানুপুরে গেলাম। সেখান থেকে মোহাম্মদ ত্বকীর হাট হয়ে রাউজান দিয়ে শহরে যাব ঠিক করে নানুপুরে নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে গাড়িতে উঠলাম। সামনে সিটে বসালাম আমাদের দলের নেতা হারুন বশরকে। শিবিরের সন্ত্রাসীদের হামলায় হারুন বশর পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। আমি তাকে সামনের সিটে বসালাম। সন্ধ্যার পর আমরা মোহাম্মদ ত্বকীর হাটে পৌঁছামাত্র হঠাৎ চারদিক থেকে একই পোশাক পরা ২০-২৫ জন সশস্ত্র লোক এসে আমাদের গাড়ি ঘিরে ফেলে। এক মিনিটের মধ্যে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে। আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে বললাম, আমি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তোমরা কি চাও? হারুন বশরকে গাড়ি থেকে বের করে চাকায় বসিয়ে ব্রাশফায়ার করার মুহুর্তে আমি সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি বললাম, সে একজন পঙ্গু মানুষ, তাকে ছেড়ে দাও। ডোন্ট কিল হিম, ইফ ইউ ওয়ান্ট কিল মি। তারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ব্রাশফায়ার করে হারুন বশরকে খুন করল’।
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এরপর আমার মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে নাছির বলল, আঁরে চিনি ল, আর নাম নাসির। আমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি হলো। রাইফেলের বাট দিয়ে আমাকে বেদম মারধর করল। তখন আমার গাড়ির পেছন থেকে তখনকার ছাত্রলীগ নেতা জসীম উদ্দিন শাহ, ইউনূস গণি, মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ বের হয়ে আসল। সন্ত্রাসীরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে ধর, ধর বলে তাদের ধাওয়া শুরু করল। এই সুযোগে আমি পাশের একটি খালে লাফ দিই। সেখানে পাটিপাতা ছিল, এর ভেতরে আমি শুয়ে থাকি। সন্ত্রাসীরা আবার ফিরে এসে এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার শুরু করল। কিন্তু অন্ধকারে তারা আমাকে দেখতে না পেয়ে চলে গেল। আমি হামাগুঁড়ি দিয়ে দিয়ে খালপাড় থেকে কিছুদূর গিয়ে হেঁটে স্থানীয় আবদুল্লাহপুর বাজারে পৌঁছলাম’।
নিজের চোখে দেখা এ ঘটনা হুবুহু আদালতে বলেছেন জানিয়ে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, সাক্ষীর অভাবে বিচার হচ্ছে না, এটা ভুল বক্তব্য। আমি নিজে সাক্ষ্য দিয়েছি। আমার গাড়িচালক ইদ্রিস, মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ তো এখনও আছে। প্রয়োজনে আদালতে তাদের জিজ্ঞেস করা হোক। আদালতের কাছে আবেদন- প্রয়োজনে আবার সাক্ষ্য দিতে আমি রাজি আছি। কিন্তু বিচার যেন আর দীর্ঘায়িত না হয়, দোষীকে যেন শাস্তি দেওয়া হয়। এই ঘটনায় যে বা যারা দোষী, তাদেরও যেন আইনানুগভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।
এর আগে, ২০১৭ সালের ২৬ মে ওই মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন মোশাররফ হোসেন। সেদিন নিহত রাজনৈতিক সহকর্মীদের চোখের সামনে হত্যার বর্ণনা দিয়ে তিনি আদালতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। মোশাররফের ওপর হামলার নেতৃত্বদাতা নাসির উদ্দিন ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার এবং একসময়ের পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। ১৯৯৮ সালের ৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম কলেজের শেরে বাংলা ছাত্রাবাস এলাকা থেকে নাসিরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর গত ২৩ বছর ধরে নাসির কারাগারে আছেন।
সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম, সহ-সভাপতি এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ পালিত ও জসীম উদ্দিন শাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক সাংসদ খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, সদস্য বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার এবং মহিলা লীগের সভাপতি দিলোয়ারা ইউসুফ উপস্থিত ছিলেন।
ডিসি/এসআইকে/আরএআর