কর্মঘণ্টা কমানো ও বেতন-ভাতার দাবির পরই রক্তাক্ত হয় বাঁশখালী

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমের ১০ কিলোমিটার পরেই গণ্ডামারা ইউনিয়নে নির্মিত হচ্ছে বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘এসএস পাওয়ার প্লান্ট’।  প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প নির্মাণ করছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ এস আলম ও চীনের সেফকো ত্রি-ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন।  প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার শ্রমিক।  স্থানীয় শ্রমিক আছেন প্রায় অর্ধসহস্রাধিক।  ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে প্রকল্পটি।
এরমধ্যে প্রকল্প ঘিরে ঘটেছে কয়েকটি বিক্ষোভ। ঝরেছে বেশ কিছু তাজা প্রাণ।  ২০১৬ সালের প্রকল্পটি ঘিরে প্রথম দফায় স্থানীয়দের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়।  এতে নিহত হয়েছিলেন চারজন।  নিহতের পরিবার-পরিজনদের ক্ষতিপূরণসহ স্থানীয়দের বেশকিছু দাবি-দাওয়া মেনে কাজ শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্প বাস্তবায়নের পাঁচ বছরের মাথায় এসে ফের ঘটল আরেকটি রক্তাক্ত সংঘর্ষ।  এবার শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন শ্রমিক।  আহত এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
শনিবারের (১৭ এপ্রিল) সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন কিশোরগঞ্জের ফারুক আহমদের ছেলে মাহমুদ হাসান রাহাত (২২), চুয়াডাঙ্গার অলিউল্লাহর ছেলে মো. রনি হোসেন (২৩), নোয়াখালীর আব্দুল মতিনের ছেলে মো. রায়হান (১৯), চাঁদপুরের মো. নজরুলের ছেলে মো. শুভ (২২) এবং বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনার আবু ছিদ্দিকীর ছেলে মাহমুদ রেজা (১৯)।
সংঘর্ষে গণ্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির তিন সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।  তারা হলেন- ইয়াসির (২৪), আহমদ কবির (২৬) ও আসাদুজ্জামান (২৩)।  আর ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।
এরপর শনিবার সন্ধ্যায় জরুরি বৈঠকে বসে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।  সেখানে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় একটি তদন্ত কমিটি।  চার সদস্যের ওই তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পুলিশের একজন, কলকারখানা অধিদফতর থেকে একজন এবং বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে একজন সদস্য নেয়া হয়।  কমিটিকে আগামি সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
বৈঠক শেষে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বলেন, ‘বাঁশখালীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়া হবে।  নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে তিন লাখ এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা করা হবে’।
এছাড়া ঘটনার তদন্তে চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের পক্ষ থেকেও গঠন করা হয়েছে আরেকটি তদন্ত কমিটি।  ওই কমিটিতে আছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপরাশেন ও ক্রাইম) জাকির হোসেন, রেঞ্জ কার্যালয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) নেছার উদ্দীন, চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) কবির হোসেন। তাদেরকেও সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
যেভাবে ঘটনার শুরু
রমজান শুরুর পর থেকে শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা কমানোর দাবি নিয়ে সরব হতে থাকেন।  তারা বর্তমানে যেভাবে কাজ করছেন, সে হিসাবে ইফতার করতে সময় পান না।  শুরু থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দাবি জানালেও মূল ঘটনার আগের দিন (শুক্রবার) প্রকাশ্যে আসেন তারা।  সেদিনের আন্দোলনে কর্মঘণ্টার সঙ্গে যথাসময়ে বেতন পরিশোধ, ঝুঁকিভাতা প্রদানসহ আরও কয়েকটি দাবি যুক্ত হয়।  তবে ঘটনা ঘিরে স্থানীয় শ্রমিকদের উস্কানিও আছে বলে দাবি করেছেন বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা।
এসবের পর শুক্রবার কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা করার আশ্বাস দেয়।  পরদিন শনিবার আবারও শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত জানতে জড়ো হতে শুরু করে।  বিক্ষোভে কিছুটা বিচ্ছিন্ন সহিংসতাও হয়।  পরে কর্তৃপক্ষ থানায় খবর দেয়।  ঘটনাস্থলে পুলিশ আসলে শ্রমিকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।  একপর্যায়ে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।  পুলিশ গুলি ছুঁড়লে তাতে পাঁচ শ্রমিক নিহত হন।
স্থানীয়রা জানান, শ্রমিকদের মূল দাবি ছিল ১০ ঘণ্টার ডিউটি রমজানে কমিয়ে আট ঘণ্টা করা হোক।  যেন শ্রমিকরা ইফতারের সময় পান।  প্রয়োজনে রোজায় যেহেতু দুপুরের খাবার খাওয়া লাগে না, দুপুরের বিরতিও বাদ দিয়ে আট ঘণ্টা ডিউটি নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন তারা।
আহতদের সঙ্গে চমেক হাসপাতালে আসা গণ্ডামারা ইউনিয়নের বাসিন্দা তৌহিদ বলেন, ‘ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিক আছে কয়েক হাজারের মতো।  তারা গতকাল ইফতারের সময় কাজ বন্ধ ও কর্মঘণ্টা কমানোর দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন।  দাবি মানার কথাও ছিল।  কিন্তু আজকে পুলিশ গুলি চালালে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।  আন্দোলনে বেতন যথাসময়ে পরিশোধের দাবি ছিল, বাড়ানোর কোনো দাবি ছিল না’।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে বিস্তারিত কর্তৃপক্ষ থেকে জানতে পারবেন।  তবে শ্রমিকরা পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে, তাই পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে।  পুলিশ কখনও আগে গুলি করে না।  এরপরও নিহতের স্বজনরা যদি অভিযোগ করে থাকেন- তবে পুলিশ কেন গুলি চালিয়েছে, তা তদন্ত করা হবে’।
বিষয়টি নিয়ে জানতে এসআলম গ্রুপ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়।  তবে অধিকাংশ কর্মকর্তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।  যে কয়েকজনকে ফোনে পাওয়া গেছে, তারাও ঘটনার বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি।
নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যমসারির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শ্রমিকরা কিছু দাবি নিয়ে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন।  কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সেখানে কর্মরত চীনা প্রকৌশলীরা দাবি মানার বিষয়ে শ্রমিকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন।  কিন্তু শনিবার শ্রমিকরা আন্দোলনের একপর্যায়ে চীনা প্রকৌশলীদের ওপর হামলার চেষ্টা করে।  তারপর কর্তৃপক্ষ থানায় খবর দেয়।  পুলিশও বিদেশি নাগরিকদের রক্ষা করতে চেয়েছিল।  একপর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়’।
গণ্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী বলেন, ‘আন্দোলন করবে বলে কর্তৃপক্ষ কোনো স্থানীয় (অর্থাৎ বাঁশখালী ও আশপাশের এলাকা) কোনো শ্রমিক নিয়োগ দেননি।  এখন বাইরের শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে।  আমি এখনও এ বিষয়ে বিস্তারিত জানি না, জেনে বলব’।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ