পটিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে লুঙ্গি খুলে পেটানোর হুমকি হুইপের

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন সামছুদ্দিন আহম্মদ।  দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিলেন।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এই জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ।  ৮০ বছর বয়সী সেই মুক্তিযোদ্ধাকে এবার লুঙ্গি খুলে পেটানোর হুমকি দিয়েছেন জাতীয় সংসদের হুইপ এবং চট্টগ্রামের পটিয়ার সংসদ সদস্য বহুল বিতর্কিত সামশুল হক চৌধুরী।  শুধু তা-ই নয়, তাঁকে লুঙ্গি খুলে বাজারে ঘোরানোর হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।  হুইপ, তাঁর ভাই ও ছেলের অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় হুইপের আক্রমণাত্মক হুমকির মুখে পড়েছেন তিনি।
এ বয়সে এসে এভাবে অপমানিত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুক্তিযোদ্ধা সামছুদ্দিন আহম্মদ।  পটিয়ায় সরেজমিনে গেলে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘হুইপ ও তাঁর পরিবারের লোকজন মানুষের ওপর জুলুম করে।  এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমাকে তাঁর রোষানলে পড়তে হয়েছে।  আমার ওপর নেমে এসেছে খড়্গ।  আগে হুমকি দিত হুইপের ভাই মোহাম্মদ আলী নবাব।  এখন হুইপ নিজেই হুমকি দিচ্ছেন।  খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি।  হুইপ কখন কী করে, তার কোনো ঠিক নেই’।
সামছুদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘আসলে হুইপ সামশুল হক আওয়ামী লীগের লোক নন।  তিনি জাতীয় পার্টি করতেন।  চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের ভেতর নালার ওপরে ছোট্ট একটি দোকান করতেন।  সেখান থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে রাতারাতি পাল্টে গেছেন।  বিশেষ করে সংসদ সদস্য এবং হুইপ নির্বাচিত হওয়ার পর দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন।  যেন রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন তিনি।  তিনি আগে কী ছিলেন, আর এখন কী হয়েছেন, পটিয়ার মানুষ সবই জানে’।
বয়োজ্যেষ্ঠ এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আসলে পটিয়ার অবস্থা অনেক খারাপ।  অনেক ভয়াবহ।  এর একমাত্র কারণ হুইপ।  পটিয়ায় তাঁর কথাই চূড়ান্ত।  এর বাইরে কারো কোনো কথা টেকে না।  স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে জনগণ, সবাইকেই তাঁর নির্দেশ মেনে চলতে হয়।  কেউ ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করে না।  আমি তাঁর বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রোষানলে পড়েছি’।
হুইপ সামশুল হকের সঙ্গে একসময় সুসম্পর্ক ছিল উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা সামছুদ্দিন বলেন, ‘সংসদ সদস্য হওয়ার পর ২০১২ সাল থেকে হঠাৎ বদলে যান সামশুল।  আওয়ামী লীগের জন্য বছরের পর বছর যাঁরা নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন, প্রতিপক্ষের মামলা ও হামলার শিকার হয়েছেন, সেই ত্যাগী নেতা-কর্মীদের দল থেকে সরিয়ে দিতে শুরু করলেন তিনি।  পক্ষান্তরে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির লোকজনকে আওয়ামী লীগে ঢোকাতে লাগলেন।  আওয়ামী লীগের নির্যাতিত নেতাদের সরিয়ে দলের বড় পদে বসাতে শুরু করেন অনুপ্রবেশকারীদের।  এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে হুইপ আমার সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে যান।  আমাকে শাসাতে থাকেন।  পরবর্তী সময়ে আর এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করেন।  আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে আমি এই অবিচারের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখি।  এর পর থেকেই হুইপ আমার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছেন’।
তিনি বলেন, সারা দেশে আওয়ামী লীগের শাসন চলছে, আর পটিয়ায় চলছে জিয়ার সেই বিচ্ছু সামশুর দুঃশাসন।  তিনি আরো বলেন, ‘হুইপের ভাই মোহাম্মদ আলী নবাব আমাকে লুঙ্গি খুলে জনসমক্ষে ঘোরানোর হুমকি দিয়েছেন।  জীবনের শেষ সময়ে এসে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে, তা কখনো ভাবতেই পারিনি।  এখন আমি পুরো পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় আছি।  নিজেও ঘর থেকে বের হই না।  আমি এসব বিষয় নিয়ে নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।  ১৯৬২ সাল থেকে আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছি আমরা।  জিয়া ও এরশাদ সরকারের সময় কত নির্মম নির্যাতনের কবলে পড়েছি।  তার পরও দলের আদর্শ ছাড়িনি।  এখন শেষ বয়সে এসে আবার হুইপের নির্যাতনের কবলে পড়েছি।  আওয়ামী লীগের লোক হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই নির্যাতন সহ্য করে চলতে হচ্ছে’।
তিনি জানান, এখানকার বালু, মাটি সব হুইপের নিয়ন্ত্রণে।  পটিয়া-বোয়ালখালী সড়ককে কেন্দ্র করেই কোটি কোটি টাকা আয় করেন হুইপ।  এই সড়কের কাজে তিনি কাউকে সম্পৃক্ত হতে দেননি।  সব নিজে নিয়ন্ত্রণ করছেন।  এ ছাড়া হুইপের একটাই কথা, ‘চেয়ারম্যান বানালে আমি বানাব।  মেম্বার বানালে আমি বানাব’।  এসব কথা বলে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বড় বাণিজ্য করেছেন।
হুইপের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সামশুল হক চৌধুরীর ভাইও এখানকার সব কাজে হস্তক্ষেপ করেন।  হুইপ অবৈধ সব কাজ-কর্ম তাঁর ভাইকে সামনে রেখে করান।  পটিয়ায় মাটি কাটা থেকে শুরু করে সব কাজে হুইপের ভাই নবাবকে টাকা দিতে হয়।  সরকারি-বেসরকারি সব কাজেই টাকা দিতে হয়।  টাকা না দিলে কাজ হয় না।  এসব কারণে পটিয়ায় রাস্তাঘাটসহ সরকারি বিভিন্ন কাজ নির্ধারিত সময়ে হয় না।  এক বছরের কাজ শেষ করতে দু-তিন বছরও লেগে যায়।  এর কারণ হলো হুইপ ও তাঁর ভাইয়ের অত্যাচার।  পটিয়ায় কোনো শান্তি নেই?।  হুইপ সামশুল হক তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী পটিয়াকে চালাচ্ছেন।  পুরো পটিয়াকে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন।
হুইপের অতীত স্মরণ করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘গ্রামে তাঁদের শুধু একটা মাটির ঘর ছিল।  সেই ঘরে তিনটা রুম ছিল।  এ ঘরেই তাঁরা চার ভাই, মা-বাবা ও বোনদের নিয়ে থাকতেন।  তাঁদের তেমন সহায়-সম্পদ ছিল না।  পরবর্তী সময়ে এরশাদের আমলে রিয়াজউদ্দিন বাজারে নালার ওপরে ছোট একটা দোকান দেন তাঁরা।  এ দোকানই তাঁদের মূল উপার্জনের পথ ছিল।  এর ইনকাম দিয়ে কোনোমতে তাঁদের পরিবার চলত।  এই মাটির ঘরে থেকেই সংসদ সদস্য হন হুইপ।  সংসদ সদস্য হয়েই তাঁদের উত্থান।  রাতারাতি ওপরে উঠতে শুরু করেন সামশুল হক।  ২০১০-১১-এর পরে তাঁরা পুরো পটিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেন।  নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে হয়ে যান হাজার কোটি টাকার মালিক।  এসব নিয়ে কথা বলায় একে একে আমাকে দলের সব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।  সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ছিলাম।  সেখান থেকেও আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে’।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযোদ্ধা সামছুদ্দিন আহম্মদ ১৯৭২ সালে ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি।  ১৯৭৫ সালের পর হন পটিয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।  ২০১০ সাল পর্যন্ত ছিলেন পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে।  ২০১৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন পটিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
এই মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার বয়স শেষ।  বুড়ো হয়ে গেছি।  এখন আর কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই।  এখন শুধু একটাই চাওয়া, আমি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।  দেখা করে হুইপের অপকর্মগুলো নেত্রীকে জানাতে চাই।  আমার বিশ্বাস, নেত্রী সব জানলে হুইপের অপকর্মের দাগ আওয়ামী লীগের গায়ে লাগতে দেবেন না।  কারণ তিনি আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন।  এটা আমি বিশ্বাস করি।  এ জন্যই আমি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।  নেত্রীর কাছে একটাই চাওয়া, পটিয়া আওয়ামী লীগকে রাহুমুক্ত করেন।  পটিয়া আওয়ামী লীগকে তৃণমূলের কর্মীদের আওয়ামী লীগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন’।

ডিসি/এসআইকে/এসইউ