গরুর গলায় ঝুলে আসছে মাদক, অবাধে দেশে ঢুকছেন ভারতীয়রাও

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
করোনা পরিস্থিতিতে পঞ্চগড়ের সীমান্তগুলোতে থেমে নেই চোরাচালান।  প্রত্যেক সীমান্তেই ফের সরব হয়ে উঠেছে চোরাকারবারিরা।  বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে গরুর সঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে মাদকও।  ফাঁকা পেলে ভারতীয় নাগরিকরাও ঢুকে পড়ছেন।  এতে সীমান্ত দিয়ে করোনার ভারতীয় ধরণ ছড়িয়ে পড়ার মারাত্মক শঙ্কা দেখা দিয়েছে।  যদিও সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে বিজিবি।  তবু থামছে না চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য।
তিন দিকে ভারতীয় সীমান্তবেষ্টিত জেলা পঞ্চগড়।  জেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে ২৮৮ কিলোমিটার।  এই সীমান্তের বেশকিছু এলাকায় নেই কাঁটাতারের বেড়া।  আবার বেশির ভাগ সীমান্তেই রয়েছে অভিন্ন নদী।  আর এসব পথই বেছে নিয়েছেন চোরাকারবারিরা।
জানা গেছে, মাদক ও গরু চোরাকারবারিদের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পঞ্চগড় সদর উপজেলার শিংরোড প্রধানপাড়া, নায়েকপাড়া, ভুজারিপাড়া, দক্ষিণপাড়া, ঘাগড়া, মোমিনপাড়া, জুলিপাড়া, বাঙালপাড়া, বড়দরগা, নালাগঞ্জ, বড়বাড়ি, অমরখানা, টোকাপাড়া সীমান্ত।  বোদা উপজেলায় রয়েছে বড়শশী, পাহাড়িয়া, ধামেরঘাট, সুয়েরপাড়, বালাপাড়া, মালকাডাঙ্গা, সরদারপাড়া, কাজীপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, মহিষবাথান ও নাওতারি সীমান্ত।
এছাড়া তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের ভূতিপুকুর, সরদারপাড়া, দেবনগর ইউনিয়নের শুকানি, কালিয়ামনি, শালবাহান ইউনিয়নের পেদিয়াগছ, তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শারিয়ালজোত, বড়বিল্লাহ, পুরাতন বাজার, সরদারপাড়া, তীরনইহাট ইউনিয়নের ভোকতিডাঙ্গী, ইসলামপুর ও রৌশনপুর, বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের দেবীভিটা, বন্দিভিটা, সরদারপাড়া, নারায়ণজোত, চুতরাগছ, উকিতজোত, জাগিরজোত, কাশেমগঞ্জ, বাংলাবান্ধা এবং আটোয়ারী উপজেলার ধামোর, তোড়িয়া, সোনাপাতিলা, গিরাগাঁও, বোদগাঁও সীমান্ত এলাকাও ব্যবহার হয়ে আসছে।
এসব সীমান্ত এলাকায় অন্তত ৩০টি চোরাকারবারি গ্রুপ সক্রিয়।  ক্ষমতার দাপট দেখাতে তাদের কাছে রয়েছে অবৈধ অস্ত্রও।  স্থান-কাল আর পরিবেশ ভেদে একেকদিন একেক স্থান ব্যবহার করা হয়।  আর চোরাচালান দেয়া-নেয়া চলে গভীর রাতে।
পঞ্চগড়ের বিভিন্ন পশুর হাটে দিন দিন ভারতীয় গরুর আমদানি বাড়ছে।  আগে শুধুমাত্র গরু এলেও এখন গরুর গলায় ঝুলে আসছে মাদকও।  মদ, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা, পেথেডিন ইনজেকশনসহ নানা ধরনের মাদক ঢুকে যাচ্ছে দেশে।  কখনো আসছে অবৈধ অস্ত্রও।  আবার ফাঁকা পেয়ে গরুসহ মাদকদ্রব্য নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন ভারতীয়রাও।  এরপর গরু কিংবা মাদক বেচে নির্বিঘ্নে ফিরে যাচ্ছেন তারা।
এভাবেই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দিব্যি চলছে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য।  অনেক সময় বিএসএফের গুলিতেও প্রাণ দিতে হয়েছে গরু ব্যবসায়ীদের।
গত বছর পঞ্চগড় সদর উপজেলায় বিএসএফের গুলিতে হাসান আলী নামে এক গরু চোরাকারবারি নিহত হন।  প্রায় দুই মাস আগে তেঁতুলিয়া উপজেলার তীরনইহাট ইউনিয়নের ঠুনঠুনিয়া এলাকার গরু চোরাকারবারি জামাল উদ্দিন অস্ত্রসহ বিএসএফের হাতে আটক হন।  তবু ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজটি করে যাচ্ছেন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা।
জেলার ২০ থেকে ২৫ জন গরু ব্যবসায়ী ভারতীয় বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রয়েছেন।  গত বৃহস্পতিবার ভোরে চোরাচালানের সময় পঞ্চগড়ের শিংরোড সীমান্ত থেকে আপেল নামে এক যুবককে আটক করে বিজিবি।  পরে তাকে পঞ্চগড় সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়।  তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেঁতুলিয়ার ভূতিপুকুর সীমান্তের এক লাইনম্যান জানান, প্রতি রাতে ওই সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে কয়েকশ গরু আনা হয়।  গরুর সঙ্গে কেউ কেউ মাদকও নিয়ে আসেন।
আরেক গরু ব্যবসায়ী জানান, এখন সীমান্তে কড়াকড়ি বেড়ে গেছে।  আগের মতো গরু আনতে পারছেন না তিনি।  অনেক সময় ভারতীয় গরু চোরাকারবারিরা গরু নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে স্থানীয়দের বাড়িতে ওঠেন।  গরু বিক্রি করে আবার ফিরে যান।
সীমান্ত দিয়ে গরুর সঙ্গে মাদকদ্রব্য ঢুকে পড়ায় জেলার যুবকদের একটা অংশ মাদকাসক্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছেন।  এছাড়া সীমান্তে দুই দেশের চোরাকারবারিদের অবাধ যাতায়াতে করোনার ভারতীয় ধরণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
জেলা নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন সরকার বলেন, ভারতে করোনার যে ভয়াবহ অবস্থা তা দেখে অন্তত আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।  সীমান্ত দিয়ে গরুর পাশাপাশি মাদকদ্রব্য আসছে বলে আমরা বিভিন্নভাবে খবর পাচ্ছি।  এছাড়া সীমান্তে চোরাকারবারিদের অবাধ যাতায়াত।  তারা ভারতীয় চোরাকারবারিদের সঙ্গে মেলামেশা করছে।  এটি আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ।
নীলফামারী ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে আমরা সীমান্তে জনবল ও নজরদারি বাড়িয়েছি।  এছাড়া সীমান্ত এলাকার মানুষদের সচেতন করার জন্য কাজ করছি।  বড়শশী সীমান্তের মতো কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে কাঁটাতারের বেড়া নেই সেখানে চোরাকারবারিরা সহজেই বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্তে যাতায়াত করছে।  অনেক সময় গরু ও মাদক নিয়ে আসার সময় আমাদের হাতে আটকও হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা করোনা পরিস্থিতিতে সীমান্তে চোরাচালান শূন্যের দিকে নিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছি।  স্থানীয়দের সহযোগিতা পেলে আমরা শিগগিরই এটা বন্ধ করতে পারবো।
পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার আনিসুর রহমান বলেন, আমরা গরু চোরাচালান নিয়ে ২৪ ঘণ্টা তৎপর রয়েছি।  বর্তমানে কোনো গরু পঞ্চগড়ের সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে পারছে না।  আমরা সব ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করছি।  শুধু গরুই নয় কোনো ধরনের মাদকসহ অন্যান্য পণ্যও ঢুকছে না।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ