সরকারি তদন্তে ‘হুইপ বাহিনীর’ টিকা বাণিজ্য প্রমাণিত, গায়েব সিসিটিভি ফুটেজ

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
টিকা নিরাপত্তার ‘কোল্ড বক্স’ ছাড়াই টিকা স্থানান্তর, রেজিস্ট্রেশন কার্ড জালিয়াতিসহ সরকারি তদন্তে ধরা পড়েছে চট্টগ্রামের পটিয়ায় ‘হুইপ বাহিনীর’ করা টিকা বাণিজ্য।  তবে উপজেলার সরকারি টিকা সংরক্ষণাগারের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব হয়ে গেছে।
তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা জানান, অনুমতি ছাড়া ও যথাযথ নিয়ম না মেনে দেওয়া হয় ২৬শ’ টিকা।  দুইদিনে দেওয়া ২৬শ’ টিকার উপস্থাপিত রেজিস্ট্রেশন কার্ডের মধ্যে অন্তত ২২শ’ কার্ডই ভুয়া।  অনুমতি ছাড়াই এই টিকাদান প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য সহকারীর মতোই হুইপ সামশুলের ভাই মহব্বত নিজেই টিকা পুশ করেছেন টিকা প্রত্যাশীদের।  সব মিলিয়ে হুইপ পোষ্য-বাহিনীর দ্বারা ভয়াবহ ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে পটিয়ায়।
সোমবার (২ আগস্ট) রাত ৮ টার দিকে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবর এ প্রতিবেদনের কপি পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান কমিটির প্রধান ডা. অজয় দাশ।  তবে তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
একই বিষয়ে কমিটির সদস্য সচিব ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. আসিফ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো মন্তব্য করেননি।
এ ব্যাপারে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, অনুমোদন না নিয়ে ও নিয়মবহির্ভূতভাবে পটিয়ার শোভনদন্ডী ইউনিয়নে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপির বাড়ি লাগোয়া একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে টিকাগুলো দেওয়া হয়। তদন্তকালে অভিযুক্ত হুইপপোষ্য কথিত ছাত্রলীগ নেতা ও ইপিআই কর্মসূচির টেকনোলজিস্ট রবিউল হুসাইন তদন্ত টিমকে মোট ২৬শ’ টিকার রেজিস্ট্রেশন কার্ড উপস্থাপন করেন। কার্ডগুলো সংশ্লিষ্ট বারকোড পরখ করে ধরা পড়েছে ভিন্নতা। ২৬শ’ কার্ডের মধ্যে দুই শতাধিক কার্ড পুরনো রেজিস্ট্রেশনকৃত।
দুই হাজারের বেশি কার্ড রেজিস্ট্রেশনের জন্য ইতোপূর্বে আইডিকার্ড নিয়ে আসা মানুষের, তাদের নামে রেজিস্ট্রেশন কার্ড রবিবার (০১ আগস্ট) সকালে পূরণ করা হয়। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে, পুরনো জমে থাকা আইডিকার্ড দিয়েই তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শনের আগেই এসব রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণ করা হয়।
তদন্ত কমিটির সদস্য ও ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান বলেন, রবিবার (১ আগস্ট) দুপুর ১ টার দিকে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া টিকাগুলো কীভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বের করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা অভিযুক্ত রবিউল হোসেনের বক্তব্য নিয়েছি। এছাড়াও যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের কয়েকজনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রধানেরও বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত সবার কাছ থেকে আমরা লিখিত ও মৌখিকভাবে বক্তব্য নিচ্ছি। করোনার টিকা দেওয়ার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় জড়িতদের তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে।
জানা যায়, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি এলাকার জনগণকে করোনার টিকা দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার পর তার নির্দেশনায় ৩০ জুলাই সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত ১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ড রশিদাবাদ আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ৩১ জুলাই সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত ৪, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ড ও ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জনগণের জন্য মহাজন হাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ আয়োজন করা হয়।
শোভনদন্ডী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে টিকা প্রদানের জন্য প্রচারণা চালিয়ে এই সময় ও তারিখে ইউনিয়নবাসীকে (৩০ বছরের ঊর্ধ্বে) আইডি কার্ড সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রে আসার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রশিদাবাদ আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে জড়ো হয় টিকা গ্রহীতারা।
টিকাদানের ঘটনায় অভিযুক্ত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) রবিউল হোসেন বলেন, স্থানীয় হুইপ, চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যরা এ বিষয়ে অবগত ছিলেন। টিকা দেওয়ার বিষয়টি আমি সবাইকে জানিয়েছি। হুইপ মহোদয় এ বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ বলেন, টিকা দেওয়ার বিষয়ে সরকারি কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। ঘটনাটি জানার পর আসলেই টিকাদান করা হচ্ছে কিনা- তা যাচাই করতে সেখানে গিয়ে সত্যতা পেয়েছি।
এদিকে সরকার গ্রামাঞ্চলে ৭ আগস্ট থেকে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা দেওয়ার পর তার আগেই পটিয়ায় টিকাদান নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। হুইপ সামশুল হক চৌধুরী নিজেকে বাঁচাতে সব দায় রবিউল হোসেনের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। অথচ সম্মতি পাওয়ার পর ব্যানারে ছাপানো হয়েছে তার ছবিও।
প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণকৃত স্থিরচিত্রে দেখা যায়, রশিদাবাদ আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যকর্মীর ভূমিকায় সিরিঞ্জ হাতে হুইপের ভাই ফজলুল হক চৌধুরী মহব্বত টিকাদান করছেন। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা দায়িত্বশীল কেউ না হয়েও তিনি কিভাবে এই দায়িত্ব নিলেন- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন টিকাগ্রহীতা বলেন, রবিউলসহ কয়েকজন ব্যক্তি টিকা পুশ করেছেন। এদের মধ্যে ফজলুল হক মহব্বতও মানুষকে টিকা দেওয়ার কাজে জড়িত ছিলেন। এসব টিকা যথাযথভাবে সংরক্ষণও করা হয়নি। টিকা নেওয়ার পর কারও বাহুতে ব্যথা বা টিকা দেওয়ার স্থানে ফুলে গেছে।
গত ৩০ ও ৩১ জুলাই স্বাস্থ্য সহকারী রবিউল সিনোফার্ম এর টিকা সরিয়ে নিয়ে হুইপের নির্দেশে এলাকার লোকজনকে দেওয়া শুরু করেন। এ ঘটনায় বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতর ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. অজয় দাশকে কমিটির প্রধান করে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. নুরুল হায়দার ও ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খানকে সদস্য করা হয়। কমিটিকে দুই কর্ম দিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। সূত্র : বাংলানিউজ

ডিসি/এসআইকে/আরএআর