এসআই স্ত্রীর দায়িত্বে থাকা মামলায় প্রভাব খাটান স্বামীও!

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
চট্টগ্রামে ইয়াবাসহ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কক্সবাজারের এক কর্মকর্তা আটকের রেশ কাটতে না কাটতে এবার আলোচনায় এসেছেন একই অফিসের আরেক কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) লাভলী ফেরদৌসী। অভিযোগ উঠেছে, এসআই লাভলী যে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান সেখানে তার স্বামী মোহাম্মদ শাহজাহানও প্রভাব বিস্তার করেন।
তদন্ত প্রতিবেদন এদিক-সেদিক করতে সুবিধামতো হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা। চাহিদামতো টাকা দিতে না পারায় বিবাদীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন বাদীর বিরুদ্ধে দেওয়ার অভিযোগও প্রকাশ্যে আসে। শুধু তাই নয়, ধার নেওয়া টাকা আত্মসাৎ ও স্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে অন্যের বসতবাড়ি দখলচেষ্টারও অভিযোগ উঠেছে।
মামলার প্রতিবেদন দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি আর্থিক লেনদেনের একটি অডিও ফাঁস হয়। এরপরই প্রকাশ্যে আসে এসআই লাভলী ও তার স্বামীর কর্মকাণ্ড। ওঠে সমালোচনার ঝড়।
অভিযোগ রয়েছে, বাদীপক্ষের জনৈক ব্যক্তি ১০ হাজার টাকা দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন এসআই লাভলী।
প্রকাশ্যে আসা অডিওতে লাভলীকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি যা আশা করছিলাম তার চার ভাগের একভাগও হয়নি। না না না, ১০ হাজার দিলে হবে না। আমরা দু’দিকে হাত রেখে কাজ করি। অন্য রিপোর্ট দেওয়াও কোনো বিষয় না। এটা কী ধরনের মামলা, কী রিপোর্ট দেব তুমি বুঝতেছ না। আপনার মামা… কথা বোঝনি, সে কখনো বলবে না ১০ হাজার দিয়েন। এটি তো আমি খরচও করে ফেলছি’।
তখন বাদীপক্ষের ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি টাকাটার জন্য এতদিন আসিনি যে’।
এসআই লাভলী বলেন, ‘না না, তুমি ১০ হাজার দিলে হবে না। তুমি আমাকে শুরু থেকে কোনো খরচ দাওনি। তোমার বুঝতে হবে সেটি। আমার ওই ছেলেটাকে দেখছো না। গাড়ির সঙ্গে গেছে। তোমার টাকা দুই হাজার নিয়ে তার কাছে দিয়ে দিছি। এরা সারাদিন হিসাব করে যায়, বিভিন্ন আইও’র সঙ্গে যায়’।
বাদীপক্ষ বলেন, আমি যা পারবো সেটি দিয়ে দিছি যে। মানে আমার..!
এসআই বলেন, তোমার কথার ওপরে কিন্তু রিপোর্ট জমা দেবো। যার দিক করতে যাবো, তার দিক থেকে একটু সুবিধা যদি না পাই, তোমার টাকা ফেরত দিয়ে অন্য রিপোর্ট দেওয়া আমার কোনো বিষয় না। এটা তুমি কী করলা, এতদিন পরে এসে।
অডিওতে এসআই লাভলীর স্বামী শাহজাহানকে কথা বলতে শোনা যায়। শাহজাহান নিজেই মামলা তদন্তে গেছেন উল্লেখ করে বিবাদী তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলেও দাবি করেন।
বাদীপক্ষকে তিনি (শাহজাহান) বলেন, জনৈক ইউনুসের জন্য তার পক্ষে রিপোর্ট দিচ্ছেন। শুধু মোবাইল ফোনের বিল দিয়েছেন ১০ হাজার টাকা।
এখানেই শেষ নয়, লাভলী-শাহজাহানের কারণে সংসার ভেঙেছে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী রাজিয়া সুলতানা রিমি। তিনি বলেন, আমার স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে একটা লাঞ্ছনার মামলা করলে তার তদন্ত পিবিআইকে দেওয়া হয়। ওই মামলার আইও হন এসআই লাভলী ফেরদৌসী। কিন্তু মামলার তদন্তের সঙ্গে আসা তার স্বামী পরিচয়ে শাহজাহান নামে এক ব্যক্তি আমার পক্ষে রিপোর্ট দিতে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। আমি তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আমার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরি। তারা চলে গিয়ে আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি থেকে দাবি মতো ৫০ হাজার টাকা পেয়ে রিপোর্টটি আমার বিরুদ্ধে দেয়।
তিনি আরও বলেন, এসব তথ্য উল্লেখ করে আমি পিবিআইর পুলিশ সুপারকে লিখিত অভিযোগ দিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি। আর তার ‘মিথ্যা’ প্রতিবেদনের কারণে আমার সংসার ভেঙে গেছে এবং আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনাও চাপা পড়ে যায়।
অন্যদিকে, কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলি এলাকার ফরিদা নামে এক গৃহবধূ বলেন, এসআই লাভলী ফেরদৌসী ট্যুরিস্ট পুলিশে থাকা অবস্থায় একদিন আমাদের কাছে এসে বলেন, বদলি হতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের ঘুষ দিতে হচ্ছে। কিছু টাকা অপূর্ণ রয়েছে উল্লেখ করে দীর্ঘদিনের পরিচয়সূত্রে লাভলী ও তার স্বামী শাহজাহান আমার সহযোগিতা চান। আমি নিজের স্বর্ণ বন্ধক রেখে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি তারা এতটা প্রতারক। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে আমাদের ক্ষতি করেছে। পারিবারিকভাবে চরমভাবে অশান্তিতে পড়েছি। এ ঘটনায় ন্যায়বিচার চেয়ে গত ১৮ আগস্ট পিবিআইয়ের মহাপুলিশ পরিদর্শক, এআইজি ও পিবিআইয়ের এসপি মহোদয়কে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
এসআই লাভলীর স্বামীর বিরুদ্ধে বসতবাড়ি দখলচেষ্টার অভিযোগও তুলেছেন চাচা রামুর চেইন্দা এলাকার ছৈয়দ আহমদ। তিনি বলেন, আমার ছেলে সন্তান না থাকায় ভাতিজারা প্রায় চাষের জমি দখলের চেষ্টা চালায়। আমার বসতবাড়ি সংস্কার করতে গেলে সেখানে বাধা দেয় শাহজাহান ও তার ভাইয়েরা। আমি আইনের আশ্রয় নিতে গেলে এসআই লাভলী থানায় (পূর্বের কর্মস্থল রামু থানায়) প্রভাব বিস্তার করেন। ফলে ন্যায়বিচার পাচ্ছি না। বর্তমানে আমার অবিবাহিত দুই মেয়ে নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। একজন পুলিশ কর্মকর্তার এ ধরনের আচরণ ও আমার ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে ১১ আগস্ট পিবিআইয়ের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শকসহ (ডিআইজি) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কনস্টেবল হিসেবে চাকরিতে যোগ দেওয়া লাভলী এসআই হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পরও ডিপার্টমেন্ট পাল্টিয়ে প্রায় একযুগেরও বেশি সময় দ্বিতীয় স্বামী শাহাজাহানের বাড়ি কক্সবাজারে অবস্থান করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মামলা তদন্তে যাওয়ার সময় স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে যান এসআই লাভলী। যা আইনত তিনি করতে পারেন না। বিষয়টি আমাদের জন্য বিব্রতকর।
এদিকে সচেতন মহল দাবি করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষের কাছে আস্থা হারাবে পুলিশ। অভিযোগ তদন্ত করে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে পিবিআই তথা পুলিশের সুনাম ধরে রাখার আহ্বান জানান তারা।
জানতে চাইলে এসআই লাভলী ফেরদৌসী সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তদন্তের জন্য এখন আমাকে তেমন মামলা দেওয়া হয় না। এরপরও আমার স্বামীর বাড়ি যেহেতু এখানে, বাদী-বিবাদী সুবিধা নিতে আমার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেই পারে। কিন্তু স্বামীর প্রভাবমুক্ত থেকেই কাজ করে আসছি। আমার স্বামী এখানকার পরিচিত মুখ। আমার প্রভাবে তার কোনো কাজ করার দরকার পড়ার কথা নয়।
তবে ফাঁস হওয়া অডিও’র বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেননি তিনি।
এ বিষয়ে পিবিআইয়ের কক্সবাজার পুলিশ সুপার (এসপি) সরওয়ার আলম বলেন, অভিযোগের বিষয়ে অবগত হয়েছি। গত ছয় মাসে লাভলীকে মাত্র একটা মামলা তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে। তবে বসতবাড়ি দখলচেষ্টার বিষয়টা তাদের পারিবারিক বলে জেনেছি।
জানতে চাইলে পিবিআই মহাপরিচালক বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ওই নারী উপ-পরিদর্শকের বিরুদ্ধে ওঠা কিছু অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত আছি। তবে ও কি (লাভলী) এখনো কক্সবাজারে কর্মরত? এমন প্রশ্ন করে পিবিআই ডিজি বলেন, আজই খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ