চমেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, তবুও সহিংস রাজনীতি

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংস রাজনীতি এবং এ থেকে সৃষ্ট সংঘর্ষ বন্ধে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সময় গ্রুপিং রাজনীতির কারণে এখানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনার প্রেক্ষাপটে এমন সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু চমেক ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্রুপের আধিপত্যের লড়াইয়ে অশান্তই থেকেছে ক্যাম্পাস। গত দেড় বছরে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এসব ঘটনায় বারবার কলেজ বন্ধ হওয়ায় শিক্ষাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্বেও এমন সহিংসতার জন্য চমেক প্রশাসনের নির্লিপ্ততাকেই দায়ী করছেন সাবেক নেতারা।
জানা গেছে, চলতি বছরের ২ মার্চ কলেজের ছাত্রাবাসে দুইপক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় ছাত্রাবাস। এর আগে ২৭ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনায় ২৮ এপ্রিল অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
এছাড়া গত বছরের ১২ জুলাই ও ১৩ আগস্ট দুই দফায় সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষ। এসব ঘটনায় গত বছরের ১৪ আগস্ট ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে নির্দেশনা দেয় চমেক প্রশাসন। ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হলেও চলতি বছরের ২ মার্চ মারামারির ঘটনায় দ্বিতীয় দফা রাজনীতি নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ছাত্রাবাসে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর পিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আবিদুর রহমান আবিদ। তিনি ছিলেন চমেকের ৫১তম ব্যাচের ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস) ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী।
স্বজনদের অভিযোগ, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের চেষ্টা করায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা কয়েক দফা পিটিয়েছিলেন আবিদকে। এরপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বোনের বাসায়। দুইদিন পর ২১ অক্টোবর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবিদ। তিনি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মধ্যম বড়ইতলী গ্রামের মৃত নুরুল কবির চৌধুরীর ছেলে।
এ ঘটনায় আবিদের মামা নেয়ামত উল্লাহ বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদের ২২ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আসামিদের দোষ প্রমাণ করতে না পারায় সব আসামি খালাস পেয়ে যান।
গত ২৭ এপ্রিল চমেক ক্যাম্পাসে ও ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনায় চমেক ছাত্রলীগের বিভিন্ন বর্ষের কয়েকজন নেতা গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চমেক হাসপাতালে দালালি ব্যবসা, অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা আদায়, হাসপাতাল সংলগ্ন ওষুধের দোকান, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাঁদাবাজি, হাসপাতালের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসকদের হুমকি-ধমকিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে হাসপাতালের সেবার মান বিঘ্নিত হচ্ছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে’।
মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের এমন সহিংস আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাবেক ছাত্রনেতারা। মারামারির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী বলেন, ছাত্রদের মধ্যে সহনশীলতা কমে যাওয়ায় এসব ঘটনা বারবার ঘটছে। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী ছাত্ররা মেডিকেল কলেজে পড়তে আসে। কিন্তু তারা যদি এমনভাবে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ায়, তা কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। যেহেতু সকলেই সরকার দলীয় নেতা-কর্মী, তাই সকলকে আরও সহনশীল হতে হবে।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও বারবার সংঘর্ষের ঘটনায় চমেক কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রশাসনের কোনো দুর্বলতা আমার চোখে পড়ছে না। কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যদি তা না মানে, প্রশাসনের কি করার থাকে?
ছাত্রদের সহনশীলতার চেয়ে প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে দায়ি করে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ছাত্রদের মধ্যে যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। তবে যেহেতু গত ২৯ অক্টোবর একটি ঘটনা ঘটেছে কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল হোস্টেলে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায়, এমন সহিংস ঘটনা ঘটেছে।
তিনি আরও বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ কয়েকদিন পর পর রাজনীতি নিষিদ্ধ করছেন। কিন্তু যারাই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পারছেন না। যা কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার পরিচয়।
চমেক ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, একসময় চমেক ক্যাম্পাসে সব দলের সহাবস্থান ছিল। তখন এমন সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ছাত্রলীগের একক আধিপত্যের কারণে বিভিন্ন ইস্যুতে তারা নিজেরাই সংঘাতে জড়াচ্ছে। যা মেডিকেল ছাত্র হিসেবে কখনোই কাম্য নয়। এছাড়া চমেক কর্তৃপক্ষের উচিত এসব ঘটনার সঠিক বিচার করা।
ডা. শাহাদাত বলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরও সংঘর্ষের ঘটনায় চমেক কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করছে। এসব ঝামেলার দায় এড়াতে পারে না কর্তৃপক্ষ। যদি ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে কেন অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, ক্যাম্পাসে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সভা-সমাবেশ বন্ধ করেছি। এরপর সভা-সমাবেশ হয়নি। হোস্টেলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ দুইপক্ষের মধ্যে ঝামেলা হয়। কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে কিছুদিন পর পর বিভিন্ন ঘটনায় কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, করোনার কারণে আমরা এমনিতেই পিছিয়ে আছি। এর মধ্যে নতুন করে ছাত্র রাজনীতির কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ যেন ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’। বারবার এমন ঘটলে শিক্ষাজীবন সময়মতো শেষ করতে পারবো কি-না, তা নিয়ে সন্দিহান। আর যারা হোস্টেলে থাকে, তারা বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। হঠাৎ হোস্টেল ছাড়তে বলা হলে এই শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।

ডিসি/এসআইকে/আরএআর