আপিল নিষ্পত্তির ৪ বছর আগেই দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে অনুমতি প্রয়োজন হয় হাইকোর্টের। হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন হওয়ার পর তা কার্যকরে আরও কিছু প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মামলার কোনো পক্ষ যদি আপিল দায়ের করে সে ক্ষেত্রে তা নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা করতে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে। অথচ চিরাচরিত সেই বিধি-বিধানের বাইরে গিয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আপিল নিষ্পত্তির আগেই চুয়াডাঙ্গার মোকিম ও ঝড়ু নামে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসামি মোকিম ও ঝড়ুর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায়। ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন একই এলাকার সাবেক ইউপি মেম্বার মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার চাচাতো ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে মোকিম ও ঝড়ুর নাম আসে। পরে ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ মামলার বিচারে তিন জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ, দুই জনকে যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন- একই ইউনিয়নের তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাকি আসামিদের খালাস দেন।
পরে মোকিম (আপিল নং- ১১১/২০১৩) ও ঝড়ু (আপিল নং- ১০৭//২০১৩) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন। তখন মোকিমের পক্ষে আপিল মামলাটি তদারকির দায়িত্ব পান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির। এরপর কেটে গেছে আটটি বছর। দীর্ঘ সময় পর সম্প্রতি মামলাটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় উঠেছে।
মামলাটি শুনানির জন্য তালিকায় ওঠার পর দরিদ্র মোকিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, আপিল নিষ্পত্তির আগেই ২০১৭ সালে মোকিমের ফাঁসি কার্যকর করেছে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের কারা কর্তৃপক্ষ। এমনকি অপর আসামি ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
নিয়ম অনুসারে, হাইকোর্ট কোনও আসামির মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের পর আপিল দায়ের করা হলে আপিল বিভাগ থেকে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এবং সংশ্লিষ্ট ডিসির কাছে এ বিষয়ে নির্দেশনা যায়। ফলে দণ্ড কার্যকর ওই সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়।
তদারকি করতে গিয়ে আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির নিজেও ঘটনার সত্যতা খুঁজে পান। তিনি বলেন, ‘বিচারপ্রার্থী মোকিম কনডেম প্রিজনার ছিলেন। বিচারপ্রার্থীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছি, কনডেম প্রিজনার মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ড ইতোমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে। মূলত মোকিম ও ঝড়ুর পরিবার খুবই দরিদ্র। তাই তাদের পক্ষে পরিবারের সদস্যরা সেভাবে মামলার বিস্তারিত খোঁজ নিতে পারেননি।’ সে সামর্থ্যও তাদের ছিল না বলে জানিয়েছেন ওই আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের পর যদি আপিল আবেদন করার ক্ষেত্রে দেরি হয়ে থাকে অর্থাৎ ‘কনডোনেশন অব ডিলে’ থাকলে ডিলে (দেরি) মওকুফের জন্য আবেদন করতে হয়। আদালত যদি ডিলে মওকুফ করে আপিল শুনানির জন্য মামলাটি গ্রহণ করে তাহলে আপিল নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকরের সুযোগ নেই’।
বিগত একশ’ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা দ্বিতীয়বারের মতো ঘটেছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আসিফ হাসান। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের নজির দেশে কখনোই দেখা যায়নি। তবে বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে উপনিবেশিক বৃটিশ শাসনামলে এমন একটি নজির পাওয়া যায়। ব্রিটিশ আমলে নন্দ কুমারের বেলায় এমন ঘটনা ঘটেছিল। ওয়ারেন হেস্টিংস এর শাসনামলে প্রতারণার অপরাধে সর্বোচ্চ সাজা ছিল সাত বছরের কারাদণ্ড। তবে সে সাজার বিধান থাকলেও ব্রিটেনের আইন প্রয়োগ করে প্রতারণার মামলায় নন্দ কুমারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাকে আপিল আবেদন করার সুযোগ দেওয়ার আগেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। তখন থেকেই ‘জুডিশিয়াল মার্ডার’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। তবে মোকিম ও ঝড়ুর বিষয়টি জুডিশিয়াল মার্ডার না হলেও হেফাজতে মৃত্যুর মতো একটি বিষয়’।
আপিল নিষ্পত্তির আগেই আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনায় পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে মামলার আইনজীবী মো. আসিফ হাসান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, এ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষের দায় রয়েছে। তাই এ ঘটনায় আমরা আপিল বিভাগের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইবো। যাদের অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে, তাদের অবহেলার উপযুক্ত বিচার চাইবো। এমন ঘটনা যেন ভবিষ্যতে না ঘটে সেজন্য সর্বোচ্চ আদালতের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাইবো। একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চাইবো’।
আপিল আবেদনের পর আসামিদ্বয়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে কারা কর্তৃপক্ষের অপেক্ষা (আপিল নিষ্পত্তির) করা উচিত ছিল বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
মোকিমের স্ত্রী মোছা. ফারজানা লেন, ‘আমরা মুরুক্ষ মানুষ। একটা মাত্র ছেলেকে নিয়ে আমি সবসময় ভয়ে থাকি। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে একটাই হত্যা মামলা ছিল। চার বছর আগে তার ফাঁসি হয়। তার (মোকিমের) ফাঁসি হওয়ার পর মেহেরপুরের ভোলাডাঙ্গা গ্রামে দাফন করা হয়। মামলাতো এখনও শেষ হয়নি’।
এদিকে মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খান।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ