সাতকানিয়ায় ফাঁসির আসামি সেই আ’লীগ নেতা গ্রেফতার

দক্ষিণ চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
এলাকায় প্রকাশ্যে থাকলেও ৫০ বারের বেশি অভিযান চালিয়েও গ্রেফতার করা যায়নি তাকে। পুলিশ হণ্যে হয়ে খুঁজলেও এলাকায় থেকেই সরব ছিলেন মাস্তানিতে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে বেপরোয়া ছিলেন তিনি। অবশেষে ধরা পড়তেই হলো তাকে। যদিও পুলিশের ভাষ্য- অর্ধশতাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।
ধুরন্ধর এই বেপোরোয়া আওয়ামী লীগ নেতার নাম বশির আহমেদ চৌধুরী। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন হত্যা মামলার রায়ে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক একেএম মোজাম্মেল হক বশির আহমেদ চৌধুরীসহ ১০ আসামিকে রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন। আদেশ দেওয়ার সময় বশির আহমেদ চৌধুরীর ভাগিনা সাতকানিয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান নেজাম উদ্দিনসহ ৭ আসামি কাঠগড়ায় উপস্থিত থাকলেও বশির আহমদসহসহ তিন আসামি পলাতক থাকে।
পরবর্তীতে গ্রেফতার এড়াতে বশির আহমদ চৌধুরী পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে গেছেন বলে এলাকায় প্রচার করা হয়। এরমধ্যেই নিজ গ্রামে জনসম্মুখে এসে নিজের অবস্থান জানান দেন এক সময়কার দাপুটে রাজনীতিক বশির। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সাতকানিয়া উপজেলার রূপকানিয়া গ্রামে নিজের সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য তৈরি করেন বিশাল সন্ত্রাসী গ্রুপ। সেই গ্রুপ দিয়ে খাল থেকে বালু উত্তোলন, মানুষের জমি দখল ছাড়াও আমজাদ চেয়ারম্যান হত্যা মামলার রায়ে উল্লসিত হওয়া মানুষদের হুমকি-ধমকি দেন। বশিরের হুমকি-ধমকিতে নিজের জীবন রক্ষায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর বশিরসহ মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামস্থ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাধারণ ডায়েরি করেন সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ রূপকানিয়া আল আমিন পাড়ার ওমর আলীর ছেলে ছরওয়ার কামাল।
জিডি করেও হামলা থেকে বাঁচতে পারেনি এই ছরওয়ার। গত ২৮ অক্টোবর রাত আনুমানিক নয়টার সময় রূপকানিয়া মহরহুম মলিহুল কবির সড়কের নাছিরের দোকান এলাকায় ছরওয়ারের উপর বশির বাহিনীর সদস্যরা হামলা চালায়। এতে ছরওয়ার গুরুতর আহত হয়ে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় এলাকাবাসী এগিয়ে আসে। খবর পেয়ে থানার এএসআই মিজানুর রহমান সঙ্গীয় ফোর্স আহত ছরওয়ারকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখানে তার অবস্থা অবনতি হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে প্রেরণ করেন। সেখানে দুই দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে সাতকানিয়া থানায় একটি মামলা করেন বশিরের বিরুদ্ধে।
মামলাটি তদন্ত করছেন এসআই মাহবুবুর রহমান। হামলার বিষয়ে ছরওয়ার কামাল বলেন, আমজাদ চেয়ারম্যান হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার পরে কিছুদিন এলাকায় না থাকলেও বশির প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এলাকায় অবস্থান করেন। আমি আমজাদ চেয়ারম্যান হত্যা মামলার নিস্পত্তিতে সহায়তা করার অভিযোগে বশির ও তার লোকজন আমাকে বার বার হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর রাতে হত্যার উদ্দেশ্যে আমার উপর হামলা করে। পরে পুলিশ এসে আমাকে উদ্ধার করে।
মৃত্যুদÐাদেশ মাথায় নিয়ে এলাকায় বশিরের মাস্তানির বিষয়ে সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, বশির এলাকায় জনসম্মুখে খুব একটা বেশি এসেছে- এই তথ্যটি আমরা জানিনা। রাতের বেলায় সে বোরকা পড়ে মাঝেমধ্যে এলাকায় এসে আবার দ্রুত গা-ঢাকা দিত- এমন খবর আমাদের ছিল। আমরা তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য কমপক্ষে ৫০ বারেও অধিক অভিযান চালিয়েছি। সর্বশেষ শনিবার (১৩ নভেম্বর) সে বাড়িতে আসার খবরে আধা ঘন্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর সাতকানিয়ার মির্জারখিল দরবার শরিফের সামনে বার্ষিক মাহ্ফিল চলাকালে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সোনাকানিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনকে। এ ঘটনায় পরের দিন ৪ অক্টোবর নিহতের স্ত্রী সৈয়দা রওশন আকতার বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। এরপর ২০০০ সালের ২২ ডিসেম্বর পুলিশ আদালতে সাতকানিয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান নেজাম উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা বশির আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইদ্রিস, মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান চৌধুরী, আবু মোহাম্মদ রাশেদ, মোস্তাক আহম্মদ, হারুনুর রশিদ, জাহেদ, ইমতিয়াজ ওরফে মানিক, জিল্লুর রহমান, মোহাম্মদ ইদ্রিস, তারেক, আইউব, ফারুক, মোহাম্মদ মোরশেদুল আলম, তাহের, ইদ্রিস, আবদুল মালেক, জসিম উদ্দিন ও লুৎফর রহমানকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এর মধ্যে লুৎফর রহমান মারা যান।
সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আনোয়ার হোসেন বলেন, গতকাল শনিবার (১৩ নভেম্বর) দিবাগত রাত আড়াইটার সময় র‌্যাব-৭ এর একটি দল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বশির আহমেদ চৌধুরীকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। আমরা থানায় থাকা গ্রেফতারী পরোয়ানামূলে তাকে রবিবার দুপুরে আদালতে সোপর্দ করি।

ডিসি/এসআইকে/আরসি