চট্টগ্রাম গণহত্যার ৩৪ বছর আজ

নগর প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
সোমবার (২৪ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস।  ১৯৮৮ সালের এইদিনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা নগরের লালদীঘি ময়দানে জনসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন।  স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী সেই জনসভায় জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করে।  আহত হন শত শত মানুষ।  সেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।
৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি বিভাগীয় বিশেষ জজের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিত মামলার রায় ঘোষণা করেন।  ২৪ জনকে হত্যার দায়ে আদালত পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।  আহত ও পঙ্গু করার অপরাধে প্রত্যেককে ১০ বছর করে কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
জানা গেছে, ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা এবং কোতোয়ালী জোনের পুলিশ পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডলসহ মোট ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।  মামলার বাদী শহীদুল হুদা, প্রধান আসামি সিএমপি’র তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদা, আসামি পুলিশ কনস্টেবল বশির উদ্দিন এবং সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আব্দুল কাদের মারা গেছেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়।  সিআইডির চার্জশিটভুক্ত আট আসামি সিএমপি তৎকালীন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা মৃত্যুবরণ করায় মামলা থেকে অব্যাহতি পান।  মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত গোবিন্দ চন্দ্র ঘটনার শুরু থেকেই পলাতক।  এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আব্দুল্লাহ এবং মমতাজ উদ্দিন কারাগারে।  এ মামলায় ১৬৮ জনকে সাক্ষী করা হয়।
রায়ে আদালত বলেন, ‘সাক্ষ্যপ্রমাণে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে ট্রাকে করে বিভিন্ন জায়গায় পথসভা করতে করতে লালদিঘীর দিকে আসছিলেন।  লালদিঘীর মাঠে ছিল তৃতীয় কর্মসূচি এবং চতুর্থ কর্মসূচি ছিল পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়।  ওইসময় পুলিশ তিনটি ব্যারিকেড দেয়।  একটি ছিল লালদিঘীতে, একটি কোতোয়ালীর মোড়ে এবং আরেকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে।  কোতোয়ালীতে প্রথম ব্যারিকেড সরিয়ে গাড়িবহর এগিয়ে যাবার পর জে সি মণ্ডল ওয়াকিটকিতে বলেন, চলে আসছে।  তখন পুলিশ কমিশনার ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দেন, হামাইয়া দাও, গুলি করে শোয়াইয়া দাও।  কমিশনারের নির্দেশে গুলিতে ২৪ জন নিরীহ ছাত্র-জনতা মারা যান।  শেখ হাসিনাকে আইনজীবীরা উদ্ধার করে আদালত ভবনে নিয়ে যান।  চট্টগ্রামের তদানীন্তন মেট্রোপলিটন কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা কর্তৃক ওয়াকিটকির মাধ্যমে প্রদত্ত অবৈধ নির্দেশে কোতোয়ালী থানার পলাতক আসামি গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল ওরফে জে সি মণ্ডলের অবৈধ হুকুমে আসামিগণ রাইফেলের গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে।  উক্ত আসামির নির্দেশে নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে মিছিলকারীদের মধ্যে ২৪ জন মৃত্যুবরণ করেন।  পরবর্তীতে পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত সাক্ষ্যপ্রমাণাদি গোপন ও বিনষ্ট করার জন্য নিহতদের মৃতদেহ ধমবর্ণ নির্বিশেষে অনেক মুসলিম ও হিন্দুদের তাদের আত্মীয়স্বজনের অগোচরে কোতোয়ালী থানার অর্ন্তগত অভয়মিত্র শ্মশানঘাটে পোড়াইয়া ফেলে’।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তার কারণে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘চার জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।  সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পরিষ্কার হয়েছে, কোনো ধরনের সহিংস ঘটনার আগেই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে’।
রাষ্ট্রপক্ষে নিযুক্ত মামলার প্রথম কৌঁসুলি স্বভু প্রসাদ বিশ্বাস বলেন, ‘আদালত বলেছেন পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার উদ্দেশে জনগণের ওপর আঘাত করা হয়েছে।  ঘটনার একদিন আগে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের ২৩ জানুয়ারি এই ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।  সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত বলেছেন, এটি পরিকল্পিত গণহত্যা’।
সোমবার সকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে শহীদদের প্রতি আদালত চত্বরের শহীদ বেদীতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ডিসি/এসআইকে/আরএআর