জাটকা রক্ষায় নদীতে ড্রেজিং নিষিদ্ধ, চলবে না স্পিডবোটও

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
পদ্মা-মেঘনা নদী থেকে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ মাছসহ অন্যান্য মৎস্যসম্পদ।  ক্ষতির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।  এ অবস্থায় জাটকা রক্ষা করে ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় মার্চ-এপ্রিল এই দুই মাস ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইলিশ গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের পরামর্শে বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) চাঁদপুরে জাটকা নিধন প্রতিরোধে জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।  একই সময় নদীতে স্পিডবোট চলাচল বন্ধ, জাটকা রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার-প্রচারণা চালানোসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. মো. হারুনর রশিদ বলেন, ‘আমাদের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী দেখা গেছে, গত বছর চাঁদপুর নদী অঞ্চলে ইলিশের বিচরণ কম ছিল।  এটির প্রধানতম কারণ হলো- নদীতে যত্রতত্র অপরিকল্পিত এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।  বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত শত শত ড্রেজারের কারণে পানি ঘোলা হচ্ছে এবং ইলিশের খাদ্য তৈরি হচ্ছে না।  কারণ, সূর্যের আলো পানিতে পড়লে ইলিশের খাদ্যকণা তৈরি হয়।  খাবার কমে যাওয়া এবং বিচরণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এই অঞ্চলে ইলিশ আসছে না’।
তিনি বলেন, ‘ডুবোচর খননের নামে বালু উত্তোলনের কারণে শুধু চাঁদপুরের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়; পাশাপাশি ইলিশ ধীরে ধীরে এই অঞ্চল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।  তাই আমরা বলেছি, জাটকাগুলো এখন সাগরে যাবে।  মাইগ্রেশন রুটগুলো নিরাপদ করে জাটকাগুলোকে নির্বিঘ্নে সাগরে যেতে দিতে হবে।  এজন্য অন্তত এই দুই মাস নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ রাখতে হবে।  এ বিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেবো’।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষক আমাদের জানিয়েছেন যে, নদীতে অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে মৎস্যসম্পদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।  চাঁদপুরের ৭০ কিলোমিটার নদী এলাকা হচ্ছে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র।  এই নদী অঞ্চলে একটি চক্র যেভাবে বালু উত্তোলন করছে তাতে নদীর নিচের মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মাছের ক্ষতি হচ্ছে, মাছের বিচরণ ক্ষেত্র, ডিম এবং জাটকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  কাজেই ইলিশ সম্পদ রক্ষা করতে হলে অবশ্যই ড্রেজিং বন্ধ করতে হবে।  এজন্য তারা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখবে বলে আমাদের জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, ইলিশ গবেষকরা যেহেতু গবেষণা করেন সেহেতু এই তথ্য আমাদের জানিয়েছেন।  তাই মৎস্যজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামি দুই মাস জাটকা রক্ষায় নদীতে ড্রেজিং বন্ধ থাকবে।
সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষায় জনপ্রতিনিধি, নৌ-পুলিশ ও জেলে-প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।  বিশেষ করে এক্ষেত্রে নদী তীরবর্তী জনপ্রতিনিধিদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে।  তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। আশা করি, জাতীয় সম্পদ রক্ষায় তারা আন্তরিক হয়ে কাজ করবেন।  আগে আমাদের জেলেদের চাল কম বরাদ্দ আসছিল।  এবার কিন্তু চাল নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।  জেলেদের চাল বিতরণে যদি কোনো অনিয়ম হয় তাহলে সেই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ট্যাগ অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, জাটকা রক্ষায় আগামি দুই মাস নদীতে ড্রেজিং বন্ধ থাকবে।  নদী সংলগ্ন যেসব খালগুলো রয়েছে সেখানে প্রতিটি খালের প্রবেশ মুখে বেড়া দিতে হবে।  প্রতিটি নৌকা ওপরে উঠিয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে এবং ইঞ্জিনচালিত যেসব নৌকা রয়েছে, সেগুলো থেকে ইঞ্জিন খুলে ফেলতে হবে।  এসবের দায়িত্বে থাকবেন ইউপি চেয়ারম্যান ও পৌরসভা হলে সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।
তিনি বলেন, আগের মতো এবারও আমাদের যৌথ অভিযান পরিচালিত হবে।  নদীপথে যাতে কোনো স্পিডবোট চলতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।  অভিযান শুরুর আগেই উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভা শেষ করতে হবে।  জেলা প্রশাসক আরও বলেন, অভিযান সফল করতে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রচার-প্রচারণা।  প্রয়োজনে ছোট ছোট গল্প, নাটিকা তৈরি করে প্রচারণা চালাতে হবে।  স্থানীয় পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে।  শুধু পুকুরের মাছের জন্য একটি বরফ কল ব্যতীত বাকি বরফ কলগুলো বন্ধ থাকবে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইমতিয়াজ হোসেন, নৌ-পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায়, নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মিল্টন কবির, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা শাহনাজ, মতলব দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা হক, হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চাই থোয়াইহলা চৌধুরী, মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান, জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মালেক দেওয়ান, কান্ট্রি ফিশিং বোর্ড মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মল্লিক ও চাঁদপুর কেন্দ্রীয় মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির তসলিম বেপারিসহ সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, চাঁদপুর নদী অঞ্চল থেকে গত কয়েক বছর ধরেই অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করছে একটি চক্র।  ফলে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করতে পারছে না সরকার।  সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য।  সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ