শান্তিচুক্তির পরও রক্তাক্ত পাহাড়ের সবুজাত প্রকৃতি

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত

বান্দরবান প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দিন দিন সংঘাত-সহিংসতায় পাহাড়ের সবুজাত প্রকৃতি রক্তাক্ত হচ্ছে।  অমানবিক ও হিংস্র ভাবে হত্যা কিংবা হত্যার উদ্দেশ্যে হামলে পরছে অপরাধীরা।  হঠাৎ করে বান্দরবানে আঞ্চলিক গ্রুপগুলোর মধ্যে হানাহানি ও রক্তপাতের এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকটাই আতঙ্কের জেলায় পরিণত হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলগুলো।  খুন হচ্ছে একের পর এক।  দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল।  এসব ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।  সরকার শান্তিচুক্তি করলেও এখনও অশান্ত পার্বত্যাঞ্চল।  অশান্ত হওয়ার বিষয়টি গতকাল রবিবার ডাকা সংবাদ সম্মেলনেও স্বীকার করেন জেলা পুলিশ সুপার।
অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতাদের ব্যক্তি স্বার্থের কারণেই খুনোখুনি বেড়েছে।  তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও অপহরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।  তবে গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস সন্তু লারমা গ্রুপ এবং সংস্কারপন্থী এমএন লারমা গ্রুপ, ইউপিডিএফ এবং সম্প্রতি নতুনভাবে আবির্ভাব হওয়া মগ লিবারেশন পার্টির সদস্যদের মধ্যে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে।  চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রাতে রুমা জোনের একটি সেনা টহল দলের উপর সন্ত্রাসীদের এলোপাতারি গুলিতে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থলেই মারা যান।  একই ঘটনায় সৈনিক ফিরোজ ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।  এসময় সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনাকালে পাহাড়ের জুম ঘরে ওঁৎপেতে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অতর্কিত গুলিবর্ষণ করতে থাকে সেনাবাহিনীর উপর।  জীবন রক্ষায় সেনা সদস্যরাও পাল্টা গুলি করে।  পরে ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস ) মূল দলের ৩ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী মারা যায়।  
এদিকে, বান্দরবানে দীর্ঘদিন জনসংহতি সমিতির একক আধিপত্য ছিল।  এতে চাঁদাবাজি-অপহরণের ঘটনা চলমান থাকলেও হত্যার খবর পাওয়া যেত না।  কিন্তু সম্প্রতি সংস্কারপন্থী এমএন লারমা গ্রুপ, মগ বাহিনী নামে নতুন একটি সংগঠনের আবির্ভাব হওয়ায় চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাড়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।  তবে এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য জেএসএসসহ উভয় গ্রুপকে দায়ী করছে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী।
তবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দাবি করেন, গত ২ বছরে বান্দরবানে বিশেষ করে সদর উপজেলার রাজবিলা ও কুহালং ইউনিয়নে ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় আওয়ামী লীগের ২৫ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছে এবং নিরীহ মানুষের উপর একাধিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ গত শনিবার বান্দরবানের রোয়াংছড়ি-রুমা সীমানায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে ৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তারাছা ইউনিয়নের ক্যচলং মৌজার পালিক্ষ্যং মুখ এলাকার পাড়াবাসীর মাঝে আতংক বিরাজ করছে।  সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী বাদাম ক্ষেতে গোলাগুলির পর থেকে পাড়াবাসীর মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।  শনিবার দুপুরে তারাছা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (সন্তু গ্রুপ) এক নেতাকে গুলি করার পর অপহরণ করে ইঞ্জিন বোটে নিয়ে যাওয়ার সময় রোয়াংছড়ির তালুকদার পাড়ায় রুমা উপজেলার মধ্যবর্তী শংখ নদীর পালিক্ষ্যং এলাকায় উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলিতে এই চারজন নিহতের ঘটনা ঘটে।  পরেরদিন রবিবার বিকালে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
তবে নিহতরা সন্ত্রাসী গ্রুপের মগ ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টি (এমএনএলপি) সদস্য বলে ধারণা করছে স্থানীয়রা।  পাড়াবাসীর ধারণা- জেএসএস ও মগ লিবারেশন পার্টির মধ্যে গোলাগুলির এই ঘটনা ঘটেছে।  মগ পার্টির একটি গ্রুপ নৌকাযোগে রুমা উপজেলায় প্রবেশ করতে চেয়েছিল।  তারা দীর্ঘদিন ধরে রুমার কয়েকটি গ্রাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য মহড়া দিয়েছে।  তাদের পরণে জলপাই রঙের পোষাক, হাতের বাহুতে ট্যাটু আঁকা ছিল।  নিহতরা সবাই ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী যুবক বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
বর্তমানে গোলাগুলিতে নিহত ৪ জনের মৃতদেহ বান্দরবান সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।  সেখানে ময়না তদন্তের জন্য কাজ শুরু করেছে সিআইডির একটি টিম।
বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অশোক কুমার পাল জানান, নিহত ৪ জনের লাশ মর্গে রয়েছে।  তাদের ময়না তদন্ত শেষ হলে কেউ লাশের শনাক্তকারী হিসেবে আসলে তাকে আইনগতভাবে লাশ দেয়া হবে।  নয়তো পৌরসভার মাধ্যমে লাশগুলো সৎকার করা হবে।  তিনি আরো জানান, নিহত ৪ জন পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল মগ লিবারেশন পার্টির সদস্য।  ঘটনায় কেউ এখনো কোনো মামলা করেনি এবং কোনো আসামিকেও আটক করা হয়নি।  ঘটনাস্থল থেকে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত ১টি ওয়াকিটকি, ২৭টি কার্তুজ, ১৫০টি টু টু রাইফেলের গুলি, কয়েকটি মোবাইল এবং সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত পোষাক ও টুপি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
মানবাধিকার কর্মী ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির বান্দরবান সভাপতি অংচমং মারমা জানান, এসব হত্যাকাণ্ডে আমাদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।  কারণ পাহাড়ে এখন বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে তাদের আধিপাত্য বিস্তারের কারণে নিরীহ মানুষগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  তবে আমার মতে, যে কোনো গ্রুপের লোক হোক, এই ধরণের হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়।  আমরা চাই শান্তি-সম্প্রীতি এবং পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান থাকুক।  সবাই নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করুক।
বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক লক্ষ্মীপদ দাশ বলেন, বান্দরবান জেলার শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত করতে তারা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি অপহরণ, গুম ও চাঁদাবাজিসহ নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।  গেল এক বছরে আওয়ামী লীগের ২৫ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে এবং অপহরণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় অর্ধশতাধিক।
জেলা পুলিশ সুপার জেরিন আখতার বলেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে প্রায় সময় সংঘর্ষ হচ্ছে।  সন্ত্রাসীদের কয়েকটি দল পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটাচ্ছে।  তবে সন্ত্রাস দমনে সেনাবাহিনী-পুলিশ-বিজিবি যৌথভাবে কাজ করছে।  এসব সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন করা হবে এবং কোনো সন্ত্রাসীগোষ্ঠিকে বান্দরবানে থাকতে দেয়া হবে না।

ডিসি/এসআইকে/এসপিআর