লোহাগাড়ায় সড়কে ৫ তরুণের মৃত্যু, ট্রাক চালানোর যোগ্যতা ছিল না চালকের, ছিল না লাইসেন্সও : র‌্যাব

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
গতকাল ২১ মার্চ (সোমবার) চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ট্রাক চালিয়ে ৫ জন মেধাবী ছাত্রের নির্মম ও নৃশংস মৃত্যুবরণের ঘটনায় শারীরিকভাবে অযোগ্য ও অর্ধপঙ্গু এবং লাইসেন্সবিহীন ঘাতক ড্রাইভার ১৮ ঘন্টার মধ্যে ধরা পড়েছে র‌্যাবের হাতে।  মঙ্গলবার (২২ মার্চ) পতেঙ্গা র‌্যাব-৭ এর কার্যারয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়।
র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ২১ মার্চ ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে একটি প্রাইভেটকারযোগে ৫ জন ছাত্র যারা সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ বন্ধু চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাচ্ছিলো।  যাওয়ার পথে প্রাইভেটকারটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের আধুনগর নামক স্থানে পৌঁছালে রাস্তার বিপরীত দিক থেকে বেপরোয়া গতিতে আসা একটি ডাম্পার ট্রাক রং সাইডে গিয়ে প্রাইভেটকারটিকে চাপা দেয়।  এ সময় প্রাইভেটকারে থাকা পাঁচজনের মধ্যে চারজনই ঘটনাস্থলেই নির্মমভাবে মারা যান।  এই ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে মৃত্যুবরণ করে।  উক্ত ঘটনাটি প্রিন্ট ও ইলেট্রিক মিডিয়াসহ সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ঘটনাার পর ট্রাকচালক মো. রিপন ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় এবং আত্মগোপন করে।  র‌্যাব-৭ এর একটি টীম উক্ত ডাম্পার ট্রাকচালককে ধরতে গোয়েন্দা নজরধারী চালায়।  নজরদারীর এক পর্যায়ে র‌্যাব জানতে পারে ঘাতক ডাম্পার ট্রাকচালক রিপন চট্টগ্রাম মহানগরীর ডবলমুড়িং থানাধীন রশিদ বিল্ডিং এলাকায় আত্মগোপন করে আছে।  মঙ্গলবার (২২ মার্চ) র‌্যাব-৭ এর একটি আভিযানিক দল সেখান তেকে ঘাতক ট্রাকচালক মো. রিপন (৩১) গ্রেফতার করে।  ভোলার লালমোহনের মহেশখালী গ্রামের মৃত মোজাম্মেল হকের ছেলে রিপন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে ট্রাকটির (রেজিঃ নং-চট্ট মেট্টো-ট-১২-০৩১৫) চালক ছিল বলে স্বীকার করে।  পরে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে অবাক হওয়ার মতো তথ্য জান যায়।
র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, রিপনকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি ডাম্পার ট্রাকটিরচালক রিপন ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে আসে এবং নিমতলা বিশ্বরোডে বসবাস শুরু করে।  প্রথমে সে গাড়ির হেলপার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করে।  ২০০৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সে গাড়ির হেলপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।  ২০০৬ সালে হেলপার থাকা অবস্থায় গাড়ি চালানোর সময় সে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হয়।  এতে তার ডান পা পঙ্গু হয়ে যায় এবং উক্ত পা প্রায় সম্পূর্ণ শক্তি হারিয়ে ফেলে।  ২০১৫ সালে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে বিআরটিএ থেকে হালকা যানবাহনের লাইসেন্স পায় এবং পঙ্গু অবস্থায় গাড়ি চালনার কারণে সে আরো অনেকগুলো দুর্ঘটনায় পতিত হয়।  পরবর্তীতে ভারী যানবাহনের আবেদন করলে তার শারীরিক অযোগ্যতার কারণে বিশেষ করে ডান পা পঙ্গুত্ব ও শক্তি হারানোর প্রেক্ষিতে তাকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়নি।  তবুও সে নিয়মিত ভারী যানবাহন নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছিল।  তার এই বেপোরোয়া বাহন চালানোর যার ফলে অত্যন্ত করুণ ও নির্মমভাবে চলে গেল পাঁচজন তরতাজা যুবকের প্রাণ।
তারা জানান, ঘটনার দিন উক্ত ডাম্পার ট্রাকের মূল চালক ছিলেন মো. নুরনবী।  সেদিন নুরনবী উক্ত গাড়িটি নিয়ে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া মেরিন ড্রাইভ ও ফোর লেইনের চলমান সড়ক নির্মানের পাথর বোঝাই করে নেওয়ার কথা ছিলো।  কিন্তু নূরনবী টানা ১০ দিন নির্ঘুম থেকে গাড়ি চালানোর কারণে ক্লান্ত থাকায়, উক্ত গাড়ি চালানোর দায়িত্ব মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে পরিবর্তন করে বদলীকৃত ড্রাইভার মো. রিপনকে দেওয়া হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, রিপন এই কোম্পানীর উক্ত ভারী ডাম্পার ট্রাক চালানোর স্থায়ী কোনো চালক নয় বা এই ধরনের গাড়ি চালানোর জন্য ভারী লাইসেন্স অথবা পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাকে গাড়ি চালাতে দেওয়া হয়।  অতঃপর সে গাড়িটি নিয়ে পেকুয়ায় মেরিন ড্রাইভ ও ফোর লেইনের সড়ক নির্মাণের পাথর আনলোড করে আসার সময় লোহাগাড়া থানাধীন আধুনগর বাজারে পৌঁছালে অত্যন্ত বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অপর প্রান্ত হতে নিয়মিত গতিতে আসা প্রাইভেটকারকে সজোরে ধাক্কা দেয়।  প্রথম ধাক্কায় প্রাইভেটকারটি থেমে গেলেও ট্রাক ড্রাইভার রিপনের ডান পায়ের পঙ্গুত্ব ও শক্তি কম থাকায় সে ব্রেক করতে পারেনি।  ফলে প্রাইভেটকারের ট্রাকটি উপরে সম্পূর্ণ উঠে যায়।  এতে ঘটনাস্থলেই হারুনুর রশিদ হীরণ (২৬), খোরশেদ আলী সাদ্দাম (৩১), রিজভী শাকিব (২৬) এবং মনছুর আলী (২৩) মারা যান এবং গুরুতর আহত মুহাম্মদ হুমায়ুন (২৫) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে।
এখানে অত্যন্ত লক্ষণীয় যে, উক্ত গাড়ির কোনো হেলপার ছিল না এবং গাড়িটি অত্যন্ত বেপরোয়া গতি এবং নিয়ন্ত্রণহীন ছিল।  দুর্ঘটনার সময় গাড়িটি (কক্সবাজার হতে চট্টগ্রামের দিকে আসতে) রাস্তার বাম পাশে থাকলেও সেটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ডান পাশে চলে যায়।  ট্রাকের ড্রাইভার শারীরিকভাবে অযোগ্য, ডান পায়ে শক্তি প্রায় নেই।  সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, এই ধরনের ডাম্পার ট্রাকের মতো ভারী যানবাহন চালানোর মত কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স বা অভিজ্ঞতা কিছুই তার নেই।  মহাসড়কপথে ড্রাইভারদের এই ধরনের অনভিজ্ঞতা, অবহেলিত ও খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণ প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ।
গ্রেফতারকৃত আসামিকে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বলে তারা জানান।

ডিসি/এসআইকে/আরএআর