পাহাড়তলী ওয়ার্ড অফিস ভবনে শোভা পাচ্ছে গণধর্ষণ মামলার আসামির ছবি সম্বলিত ব্যানার!

নগর প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
১৫ বছরের এক কিশোরীকে ৩ জন মিলে একাধিকবার ধর্ষণে যুক্ত আসামির ছবিসহ ডিজিটাল ব্যানার শোভা পাচ্ছে নাগরিক সেবাকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসের মূল ভবনে!  চট্টগ্রাম নগরের ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড অফিসের মূল ভবনের দ্বিতীয়তলায় অন্তত ৬০টি পেরেক দিয়ে মজবুতভাবে সাঁটানো সেই ব্যানারটি গণধর্ষণ মামলার আসামি কথিত ছাত্রনেতা কামরুল হাসান শিবলু’র।  চলতি মাসের ৪ এপ্রিল রাতে পশ্চিম খুলশীর ‘নিভৃত নিলয়’ নামক বাড়ি থেকে ডবলমুরিং থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কাশেম ভূইয়া কর্তৃক ধৃত এই আসামি কিশোরীকে গণধর্ষণের কথা স্বীকার করে এখন জেল হাজতে আছেন।  পশ্চিম খুলশীর ‘নিভৃত নিলয়’ বাড়িটিতেই বাড়ির মালিকের পরিবারের সদস্য হিসেবেই বসবাস করছিল কামরুল হাসান শিবলু।  ধর্ষণের অপরাধে জেলে গেলেও শিবলুর ছবি ছাড়াও কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর ছবি সম্বলিত ডিজিটাল ব্যানারটি ওয়ার্ড অফিস ভবনে জ্বল জ্বল করছে এখনো।  একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড অফিস ভবনের মূল দেয়ালে একজন চিহ্নিত ও স্বীকারোক্তি দেয়া ধর্ষণ মামলার আসামির ছবি ও ব্যানার ৫০-৬০টি পেরেক মেরে সাঁটানো দেখে বিষ্মিত হচ্ছেন স্থানীয় সচেতন সেবাপ্রার্থীরা।  এছাড়াও আসামির সাথে বিভিন্ন সময় অন্তরঙ্গ মূহুর্তে কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর কিছু ছবিও শোভা পাচ্ছে আসামি শিবলুর ফেসবুক আইডিজুড়ে।  ফলে বিব্রতবোধ করছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, গত ৩ এপ্রিল ১৫ বছরের এক কিশোরী চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল।  ওই কিশোরী দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় পোস্তারপাড় এলাকার মো. সুলতান খান ও জয়নাব বেগমের ছেলে সাদ্দাম হোসেন (৩১),  পশ্চিম খুলশীর ‘নিভৃত নিলয়ে’ বসবাসকারী মিরসরাইয়ের মো. নুরুল আলম ও সেলিনা আকতারের ছেলে কামরুল হাসান শিবলু (৩০) এবং পোস্তারপাড় এলাকার আব্দুর রাজ্জাক সওদাগর বাড়ির মৃত আব্দুর রাজ্জাক ও লায়লা বেগমের ছেলে মো. রাজু (৩০) ওই কিশোরীকে স্টেশনে পৌঁছে দিবে বলে সিএনজি অটোরিকশায় তোলে এবং উল্লেখিত আসামিরা মেয়েটিকে জোরপূর্বক পালাক্রমে ধর্ষণ করে।  শুধু একবার নয়, একাধিকবার ধর্ষণের এই ঘটনার এক পর্যায়ে কিশোরী চিৎকার করলে এলাকার মানুষজন জড়ো হয় এবং তারা আসামিদের পালিয়ে যেতে দেখেন।  খবর পেয়ে সিএমপির ডবলমুরিং থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং কিশোরীকে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।  এই ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলায় (মামলা নম্বর ০৬/২২, তারিখ : ০৪/০৪/২০২২ইং) একে একে অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেফতার করে পুলিশ।  এসময় যে সিএনজি অটোরিকশায় ওই কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয় সেই অটোরিকশাটি (চট্টমেট্রো- থ- ৮৪৫৩) জব্দ করে পুলিশ।
ধৃত আসামি কামরুল হাসান শিবলুর বর্তমান ঠিকানা হিসেবে মামলার সব নথিতে পশ্চিম খুলশীর ‘নিভৃত নিলয়’ উল্লেখ করেছে পুলিশ।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল রাতে মামলার পলাতক আসামি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংসদের কথিত সংগঠক ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়দানকারী কামরুল হাসান শিবলুকে পশ্চিম খুলশীর ‘নিভৃত নিলয়’ থেকে গ্রেফতার করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ।  থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম ভূইয়ার নেতৃত্বে শিবলুকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানা গেছে।  মূলত কিশোরীকে গণধর্ষণ মামলার আসামি শিবলুর গ্রামের বাড়ি মিরসরাই উপজেলার ভোরের বাজারস্থ সাখেরখাল গ্রামে।  চট্টগ্রামে সে ‘নিভৃত নিলয়’ বাড়িটিতেই থাকতো বলে স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক নেতা ও বাসিন্দারা নিশ্চিত করেছেন।
কিশোরী ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতার এই তিন আসামিকে পুলিশ আদালতে সোপর্দ করে ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে ১ দিনের রিমান্ডে পায়।  গত ১২ এপ্রিল একদিনের সেই রিমান্ডে ধৃত ৩ আসামিই কিশোরীকে ভয় দেখিয়ে একাধিকবার পালাক্রমে গণধর্ষণের কথা স্বীকার করে।  পুলিশও মামলার ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার স্বাক্ষপ্রমাণ পেয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে এবং তাদের জামিন যেনো দেয়া না হয় সে জন্য আবেদন করে পুলিশ।

কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর সাথে কামরুল হাসান শিবলু।

ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম ভূইয়া দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, আমাদের থানার আওতাধীন এলাকায় ১৫ বছরের এক কিশোরীকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করা হয়।  সেই ঘটনায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহ করি।  পরে ভুক্তভোগী কিশোরী ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় আমরা সব আসামিদের গ্রেফতার করি।  তাদের ১ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সব আসামিই এই গণধর্ষণে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে।  রিমান্ড শেষে আমরা আসামিদের আদালতে সোপর্দ করেছি।  এই ঘটনায় ব্যবহৃত একটি সিএনজি অটোরিকশাও জব্দ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।  খুলশী থেকে মামলার আসামি কামরুল ইসলাম শিবলুকে গ্রেফতারের বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, পশ্চিম খুলশীর ‘নিভৃত নিলয়’ নামক একটি বাড়ি থেকে ২ নম্বর আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।  ওই বাড়িটি কোনো কাউন্সিলরের বাড়ি কিনা আমার জানা নেই।  আমরা আসামি ধরেছি, যাবতীয় আইনী প্রক্রিয়া শেষে তাদের আদালতে সোপর্দ করেছি।  তারা এখন কারাগারে রয়েছে বলে তিনি জানান।
একজন ধর্ষকের বড় আকারের ছবিযুক্ত পেরেক মারা ব্যানার সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড অফিসের মূল ভবনে সাঁটানোর বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, যে কেউই তার ব্যানার সাঁটাতে পারে, এতে দোষের কিছু নেই।
‘চসিক ওয়ার্ড অফিসের মূল ভবনে একজন আসামি এভাবে ৫০-৬০টি পেরেক মেরে ব্যানার সাঁটাতে পারে কি না’- এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি বেশ কিছুদিন হলো ওয়ার্ড অফিসে যাই না।  যদি মূল ভবনে এমন ব্যানার থাকে তাহলে সরিয়ে ফেলতে বলবো’।  আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিভৃত নিলয়’ নামে আমার কোনো বাড়ি নেই।  আমার বাড়ির কোনো নামই নেই।  আর কামরুল হাসান শিবলু নামে কোনো অপরাধীকে আমি চিনি না।  আর কোনো আসামি আমার বাড়িতে থাকার প্রশ্নই আসে না।  এমন কাউকে আমি চিনি না। 

ডিসি/এসআইকে/আরসি