দুর্নীতি-অনিয়ম-অদক্ষতায় ডুবছে পরিবেশ অধিদপ্তর : দুদকের অনুসন্ধান

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। মানুষের অসচেতনতা ও অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভূমিকা রাখার কথা। অথচ এ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। উৎকোচ নিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড জেনেও নিশ্চুপ থাকছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাতিষ্ঠানিক টিমের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থাটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছয়টি দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করেছে। দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ অধিদপ্তরের দুর্নীতি রোধ ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে ১৯টি সুপারিশও করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানে তরল বর্জ্য পদার্থ পরিশোধনে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) না থাকলেও উৎকোচ নিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ইটভাটা চালানোর জন্য লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেও নিয়ম-নীতি মানেন না অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণে নদ-নদী, খাল আরও বেশি দূষিত হচ্ছে। ক্রমে পরিবেশ পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
দুদক দুই ধরনের কার্যক্রম করে থাকে। প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক। প্রতিকারমূলক কার্যক্রম হিসেবে তারা সুপারিশ করতেই পারেন। সুনির্দিষ্ট খাত ধরে দুদক সুপারিশ করবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। এটা দুদক প্রত্যাশা করতে পারে। তবে শুধু সুপারিশ করা খুব একটা যৌক্তিক নয়। দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধান ও সুপারিশ করেই দুদকের কাজ শেষ হয়ে যায় না। অধিকতর অনুসন্ধান করে কারা এ অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সেটাও বের করা উচিত। সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। তাহলে দুদকের এ ধরনের কার্যক্রম সফলতা পাবে, মানুষেরও আস্থা ফিরবে
গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে থেকে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরে সংঘটিত পৃথক দুটি অনিয়ম-দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। এ অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দুদকের অনুসন্ধান ও বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে আসা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করতে এবং তা রোধে সুপারিশমালা প্রণয়নে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে দুদক। টিমগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি-বিধানের পদ্ধতিগত ত্রুটি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব, জনবল সংকটে দুর্নীতির যে ক্ষেত্র তৈরি হয়, তার উৎস চিহ্নিত করতে কাজ করে। তারা দুর্নীতির এসব উৎস বন্ধে বা প্রতিরোধে বাস্তবতার নিরিখে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে সুপারিশমালাও প্রণয়ন করে।
এরই ধারাবাহিকতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন, বিধি, পরিচালন পদ্ধতি, সরকারি অর্থ অপচয়ের দিকসমূহ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা নিরূপণ করে দুদক। অধিদপ্তরের দুর্নীতি রোধে সুপারিশমালাও প্রণয়ন করে। প্রাতিষ্ঠানিক এ টিমে নেতৃত্ব দেন দুদকের একজন পরিচালক। তার সঙ্গে ছিলেন একজন করে উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক।
প্রাতিষ্ঠানিক টিম অনুসন্ধানকালে পরিবেশ অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অধিদপ্তর সম্পর্কে প্রকাশিত অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবেদন, ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, অধিদপ্তরের বার্ষিক বিবৃতি, নিরীক্ষা ও অডিট প্রতিবেদনও সংগ্রহ করে। পরে অধিদপ্তরের বিধি ও আইন দিয়ে তা পর্যালোচনা করা হয়। এর ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক টিম অধিদপ্তরের দুর্নীতির উৎস ও ক্ষেত্র চিহ্নিত করে এবং তা প্রতিরোধে সুপারিশমালা প্রতিবেদন আকারে কমিশনে জমা দেয়। এ প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
উৎকোচ নেন কর্মকর্তারা, কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু সংখ্যক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। উৎকোচ নিয়ে তারা পরিবেশ আইন ও বিধিবহির্ভূত কাজ করছেন। পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দিলেও তা কেবল কাগজে-কলমে থাকছে। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের মধ্যে দূষণরোধে পরিবেশ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও শাস্তির বিধান নিশ্চিতে অনীহা স্পষ্ট।
শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দূষণকারী বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের যোগসাজশের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অধিদপ্তরে জবাবদিহিতার অভাবও স্পষ্ট। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান মেয়াদোত্তীর্ণ ছাড়পত্র ব্যবহার করছে এবং তা নবায়নে অনীহা দেখাচ্ছে।
তবুও অধিদপ্তর কার্যকর বা কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও নিরীক্ষায়ও ঘাটতি রয়েছে। পেশাগত দক্ষতার অভাব ও সম্পৃক্ত দপ্তরগুলোর মধ্যে নেই সমন্বয়। তারা জনসম্পৃক্তও নন। এতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
৪০০ কোটির ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্পে দুর্নীতি
পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও দুর্নীতি ও গরমিল পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে দুর্নীতির উৎস প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে গিয়ে কয়েকটি প্রকল্পে অনিয়মের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে একটি ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ শীর্ষক প্রকল্প। এ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিম্নমানের কাজ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ না করেই ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহে গেলে দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র ধরা পড়বে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ইনস্টিটিউশনাল স্ট্রেংথেনিং প্রজেক্ট’ নামের আরেকটি প্রকল্পেও অসামঞ্জস্যতার তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা প্রকল্পেও একই ধরনের অসামঞ্জস্যতা বিদ্যমান। কক্সবাজার ও হাকালুকি হাওরে কোস্টাল ম্যানেজমেন্ট এবং ওয়েটল্যান্ড বায়ো-ডাইভারসিটি ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ‘থ্রি আর’ প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
দুদকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বরিশাল-খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘূর্ণিঝড় সহনীয় গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে শত কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবে তা দৃশ্যমান হয়নি। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেচ প্রকল্পের (ইছামতি ইউনিট) জন্য প্রায় ২১ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় দেখানো হলেও তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক স্থাপন ও গাণিতিক মডেল সমীক্ষা প্রকল্পেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। সারাদেশে বাস্তবায়িত ‘প্রোগ্রাম্যাটিক সিডিএম’ শীর্ষক প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।
যত্রতত্র ইটভাটা, নেপথ্যে অধিদপ্তরের গাফিলাতি
ইটভাটার লাইসেন্স ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে বলেও দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনের বিধান থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ইটভাটা মালিক আইনের কিছু সুবিধা নিয়ে ফায়দা লুটছে। তারা কংক্রিট, কমপ্রেসড ব্লক ইট প্রস্তুতের নামে কৃষিজমি, পাহাড়, টিলা, মজা-পুকুর, চরাঞ্চল ও পতিত জায়গা থেকে মাটি কেটে এনে ইট বানাচ্ছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, বেশির ভাগ ইটভাটা আইনের বিধান লঙ্ঘন করছে। তারা জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করছেন। আইনের বিধানে নিষিদ্ধ- এমন এলাকায় ইটভাটা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ লাইসেন্সও দিয়ে হচ্ছে। লাইসেন্স গ্রহণের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিষিদ্ধ এলাকায় ইটভাটা গড়ে তুলছে। এতে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শন কমিটির তৎপরতা আশানুরূপ নয়। পরিদর্শন কমিটির সদস্যরা ব্যক্তিগত লাভের আশায় এসব অনিয়ম দেখেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন না।
টাকা দিলেই মেলে পরিবেশগত ছাড়পত্র
পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া এবং তা নবায়নের ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা নিচ্ছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। দুদকের প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেশের বেশিরভাগ বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানেই তরল বর্জ্য পদার্থ পরিশোধনে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) নেই। ফলে বর্জ্য পরিশোধনের অভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। অথচ নিয়ম-নীতি ও শর্তভঙ্গ করা শিল্প-কারখানাকে পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। পরে তা নবায়নও করে দিচ্ছেন।
ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে কি না, তা যাচাই না করেই আর্থিক সুবিধা পেয়ে অফিসে বসে ছাড়পত্র প্রদান ও নবায়ন করা হয়। এসব ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা লাখ লাখ টাকা ঘুস নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে হিডেন ইকোনমির আওতায় প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিবেশ দূষণ করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের অন্যান্য সম্পৃক্ত দাপ্তরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই স্বার্থান্বেষী মহল বিধি-বহির্ভূতভাবে যত্রতত্র শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছে। এসব শিল্প-কারখানা থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ও নির্গত বিষাক্ত গ্যাস/ধোঁয়া পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। মেইনস্ট্রিম ইকোনমির আওতাভুক্ত না থাকার কারণে এসব শিল্প কারখানায় মনিটরিং কার্যক্রমও হচ্ছে না। ফলে দিন দিন হিডেন ইকোনমির প্রসার ঘটছে।
দুর্নীতি-অনিয়ম রোধে দুদকের সুপারিশ
ইটভাটা নির্মাণ ও ইট বা ব্লক প্রস্তুতের ক্ষেত্রে লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করার বিধান রাখতে হবে। লাইসেন্স ও ছাড়পত্র দেওয়ার আগে পরিদর্শন টিমকে নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। আইনের শর্তাবলি পরিপালন সাপেক্ষে লাইসেন্স ও ছাড়পত্র দিতে হবে। শিল্প-কারখানা, হোটেল-মোটেলসহ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি পরিদর্শন কমিটির ওপর মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করাও জরুরি।
দূষণ-দখলে অস্তিত্ব সংকটে মাথাভাঙ্গা নদী
দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক অনুসন্ধান টিমের অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- পরিবেশ অধিদপ্তরকে আধুনিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিকমানের পরিবেশবিদদের মতামত ও সুপারিশ নিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিপিআরের বিধান সঠিকভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করা, টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিতে নিরপেক্ষ পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা, পরিবেশ রক্ষায় প্রচলিত আইন ও বিধিমালায় থাকা শর্ত যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। অনিয়ম, অপরাধ ও দুর্নীতি চিহ্নিত করে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
যা বলছে বাপা ও টিআইবি
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েও সুশাসন, দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাব আছে। এজন্য তাদের জবাবদিহিতার জায়গাও দুর্বল। পরিবেশ অধিদপ্তর এসব বিষয়ে গণমাধ্যম ও স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলতে তেমন’। স্বাচ্ছন্দ্য বোধও করে না। তারা অ্যাভোয়েড করতে চান। জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করাই প্রমাণ হয় যে, তাদের দুর্বলতা রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ায় দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি হবে কি না, সেটা আগে থেকে বিশ্লেষণ করার জন্য অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের এখানে ছাড়পত্র নেওয়ার আগেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যায়। আইন লঙ্ঘন বা নীতিবহির্ভূত কাজের মাধ্যমে ছাড়পত্রের তোয়াক্কা না করা সামগ্রিকভাবে সরকারের দুর্বলতা। অন্যান্য মন্ত্রণালয় কিংবা প্রকল্প যখন অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন হয়, তখন অধিদপ্তরের দুর্নীতি করা ছাড়া কোনো পথ থাকে না। এ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানো না হলে যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়বে। এখানে পরিবেশ অধিদপ্তর ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা উভয়ই দুর্বল। এ কারণে বাজেটেও পরিবেশ খাতে বরাদ্দ কম দেখি’।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়াতে সরকারকে আরও আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাপা নেতা শরীফ জামিল আরও বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি হলে সেটা ঠিক করা যায় না। একটা নদী আপনি বানাতে পারবেন না। কিন্তু ১০টি কল-কারখানা আপনি বানাতে পারবেন। তাই পরিবেশ ঠিক রেখে শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে দেওয়া উচিত’। প্রতিবেদন জাগো নিউজের
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদক দুই ধরনের কার্যক্রম করে থাকে। প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক। প্রতিকারমূলক কার্যক্রম হিসেবে তারা সুপারিশ করতেই পারেন। সুনির্দিষ্ট খাত ধরে দুদক সুপারিশ করবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। এটা দুদক প্রত্যাশা করতে পারে। তবে শুধু সুপারিশ করা খুব একটা যৌক্তিক নয়। দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধান ও সুপারিশ করেই দুদকের কাজ শেষ হয়ে যায় না। অধিকতর অনুসন্ধান করে কারা এ অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সেটাও বের করা উচিত। সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। তাহলে দুদকের এ ধরনের কার্যক্রম সফলতা পাবে, মানুষেরও আস্থা ফিরবে’।
সাড়া মেলেনি মন্ত্রী ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের
দুদকের প্রতিবেদনে উঠে আসা এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ বিষয়ে জানতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে তার মোবাইল নম্বরে এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। এছাড়া তার হোয়াটসঅ্যাপেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি। অন্যদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে একই প্রসঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ