কুলাউড়ায় দুর্গম পাহাড়ে ‘অপারেশন হিলসাইড’, আটক ১০

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের জুগিটিলা গ্রামে ‘জঙ্গি’ আস্তানা সন্দেহে ১২ ঘণ্টা ধরে একটি বাড়ি ঘিরে রেখেছিল কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, সোয়াট ও পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন। তিনি জানিয়েছিলেন, দুর্গম পাহাড়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও সোয়াট পরিচালিত অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন হিলসাইড’।
শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামের জুগি টিলায় অবস্থিত একটি বাড়িতে এ অভিযান শুরু হয়। শনিবার (১২ আগস্ট) ভোরে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে অতিরিক্ত কমিশনার মো. আশরাফুজ্জামান ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ সময় সকালে সোয়াটের ২০-২২ জনের একটি দল অভিযানে যোগ দেয়।
স্থানীয় থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারে কুলাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী গহিন অরণ্যে এক কাতারপ্রবাসীর ৫০ শতক টিলাভূমি কিনে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন সংগঠনের কার্যক্রমের জন্য আস্তানা গড়েছিল ‘জঙ্গিরা’।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) দুর্গম পাহাড়ে গত সাত দিনের নজরদারির মাধ্যমে উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিউলির জুগিটিলা গ্রামে এই নতুন সংগঠনের সদস্যদের আস্তানার সন্ধান পায়। এরপর শুক্রবার রাত থেকে শনিবার (১২ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ওই এলাকার একটি টিলায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ও সোয়াট এবং পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে নারীসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের সঙ্গে থাকা তিন শিশুসন্তানকেও উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, নতুন ‘জঙ্গি’ সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ সদস্যদের অস্তিত্ব পাই। তারা জিহাদের নামে বেশ কিছু লোককে সংঘবদ্ধ করে দীক্ষা দিয়ে কুলাউড়ার এই গহিন পাহাড় এলাকায় আস্তানা গড়ে তুলেছিল। গ্রেফতারকৃতরা টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা।
ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় ও অভিযানে থাকা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে জানা যায়, মাস তিনেক আগে কুলাউড়ার কর্মধার পূর্ব টাট্টিউলী গ্রামের বাসিন্দা ও কাতারপ্রবাসী রাশিদ মিয়ার মালিকানাধীন ৫০ শতকের টিলাভূমি ক্রয় করে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। এটি ক্রয়ে স্থানীয় এক ব্যক্তি তাদের সহযোগিতা করেন। ওই টিলায় চারটি টিনের ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করে শিশু-নারীসহ ১৫-১৬ জন সদস্যের পরিবার। প্রয়োজন ছাড়া ওই টিলা থেকে নামত না তারা। তাদের চলাফেরা নিয়ে স্থানীয়দের সন্দেহ হলে নদীগর্ভে নিজেদের বাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ায় এখানে এসে ভূমি ক্রয় করেছে এবং তারা সেখানে সবজি চাষ ও সামাজিক বনায়ন করবে বলে জানায়।
এদিকে সপ্তাহখানেক আগে সংগঠনের এক সদস্য তার পরিবারকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঢাকায় গেলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করে সিটিটিসির সদস্যরা। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে কুলাউড়ার জুগিটিলায় তাদের নতুন আস্তানার কথা স্বীকার করে। সেই সূত্র ধরে সিটিটিসির সদস্যরা ওই এলাকায় প্রায় সাত দিন সেখানে অবস্থানরত সংগঠনের সদস্যদের নজরদারিতে রাখেন। নিশ্চিত হওয়ার পর শুক্রবার রাতে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ও সোয়াট এবং পুলিশ ওই টিলা ঘিরে রাখে। সকাল ৬টা থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে রফিকুল ইসলাম, হাফিজ উল্লাহ, খায়রুল ইসলাম, শরীফুল ইসলামসহ তাঁদের স্ত্রী চারজন ও আরো দুই নারীকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের তিন শিশুসন্তানকেও উদ্ধার করে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে নগদ ৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা, বোমা তৈরির বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন সামগ্রী ও জিহাদী বই উদ্ধার করা হয়। পরে পার্শ্ববর্তী আছকরাবাদ খেলার মাঠে উদ্ধার করে বোম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করেন।
ওই টিলায় গিয়ে দেখা যায়, টিনের তৈরি চারটি ঘরে বিপুল পরিমাণ চাল, সয়াবিন তেলসহ খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসাসামগ্রী মজুত করে রাখা হয়েছে। তা ছাড়া তাঁদের ব্যবহৃত বিভিন্ন গৃহসামগ্রী রয়েছে।
অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এই সংগঠনের প্রধান যে ব্যক্তি, তার নাম-পরিচয় পেয়েছি। এই মুহূর্তে তার নাম পরিচয় বলতে পারব না। তাকে গ্রেফতারে আমাদের বাহিনী কাজ করছে। এরা নতুনভাবে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করেছে। তাদের কার্যক্রম যাতে নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে, সে জন্য এ রকম নির্জন গহিন পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা গড়ে। তারা যে জমি কিনেছে, সেটি ৫০ শতক। তাদের কাছ থেকে দলিলটি উদ্ধার করেছি। তবে জমির দাম যেটি দলিলে লেখা, সেটি সঠিক কি না এবং কী পরিমাণ অর্থ এখানে ব্যয় হয়েছে, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্ত করে জানতে পারব। এখানে কারা আসা-যাওয়া করত, তাদের নাম-পরিচয় পেয়েছি। তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে’।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন সিটিটিসির জয়েন্ট কমিশনার কামরুজ্জামান, সোয়াট কমান্ডার এডিসি জাহিদ, মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার মনজুর রহমান, কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুছ ছালেক।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ