১৫ আগস্টের অধরা ৫ খুনি কি শাস্তি পাবে না?

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পলাতক পাঁচ খুনির তিনজনের অবস্থান এখনও শনাক্ত হয়নি; তাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছেও নতুন তথ্য নেই। ফলে অধরা এই ৫ খুণী আদৌ শাস্তির মুখোমুখি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বাংলাদেশের নাগরিকেরা। দুই দফায় ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হলেও অধরা বাকি পাঁচ খুনির মধ্যে অবস্থান শনাক্ত করা দুইজনকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষষটি ঝুলে আছে।
পলাতক পাঁচজন হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী। এদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের বারবার দাবির পরও তাদের ফেরত পাঠানো হয়নি। বাকি তিনজনের কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত পায়নি সরকার কিংবা গোয়েন্দারা।
এই পাঁচজনের বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য নেই বলে জানান, ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) এর এআইজি শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান। সোমবার তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে নতুন কোনো তথ্য নেই। আগের মতোই অবস্থা’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। একদল সেনা কর্মকর্তা এ হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিলেও এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন। এ হত্যাকাণ্ডের অন্য খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার এক দশক পরেও পলাতক তিনজনের অবস্থান শনাক্ত করতে না পারার বিষয়ে পুলিশের সাবেক আইজি সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, এই তিনজন হয়তো তাদের নাম, পরিচয় সব কিছুই গোপন করে সব কিছু নতুন পরিচয়ে যেদেশে আছে সেখানে অবস্থান করছে। ফলে শনাক্ত করা দূরহ।
আরেক সাবেক আইজি নূরুল হুদার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রযুক্তির এই যুগেও তাদের শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ার বিষয়টি। তিনি বলেন, এখনকার প্রযুক্তিতে নিজেকে আড়াল করা আশ্চর্য কিছু না। আমি যদি রিয়েল আইডেন্টিটিতে না থাকি তা হলে বের হবে কী করে, আইডি হাইড করে থাকা যায়। প্রযুক্তিতে মানুষের চেহারাও চেঞ্জ করে দেওয়া যায়।
তাদের আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে শনাক্তের চেষ্টা করা যায় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইনত কাউকে জোর করা যায় না। আবার তাদের আত্মীয়স্বজনও তাদের সঙ্গে যোগযোগ নাও করতে পারেন। তবে চেষ্টা থাকতে হবে পলাতকদের বের করার জন্য। এমন পরিপ্রেক্ষিতে পলাতক খুনিদের সন্ধান পেতে পুরস্কার দেওয়ার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। দুই দেশে অবস্থান করা অপর দুই খুনিকে ফেরাতে সরকারের নানান উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
জাতীয় শোক দিবসের আগের দিন সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংবাদিক ফোরাম আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি সব দেশবাসীকে বলব, যাদের কোনো ঠিকানা আমরা পাই নাই, এদের তথ্য দিয়ে আপনি পুরস্কৃত হবেন। আমরা পুরস্কার ঘোষণা করছি, যে এদের তথ্য দিতে পারবে, সরকার তাদের পুরস্কার দেবে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে দুই খুনিকে ফেরত পাঠাতে বহুবার আলাপ হলেও তারা বিভিন্ন রকম অজুহাতে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়নি বলেও অভিযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকা রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে মোমেন বলেন, ওদের জন্য আমরা অনেক চিঠিপত্র লিখেছি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েও আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে আমরা চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা সবসময় আমাদেরকে বলে যে, ইস্যুটা তাদের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে আছে। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস প্রায় দুবছর আগে চাইল যে, আমাদের দেশে যে কেইসটা হয়েছে, কেইসটা কীভাবে হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার জন্য। আমরা সেসব তথ্য তাদেরকে দিয়েছি। এখন আমরা যখন স্টেট ডিপার্টমেন্টে অ্যাপ্রোচ করি, তারা বলে যে, এটা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে আছে। আর নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয় নাই।
যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত সে দেশের সরকার পর্যালোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে তিন বছর আগে খবর এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ২০২০ সালের ১৭ জুন দেশটির ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডের কাছে রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় মামলার নথি পর্যালোচনার জন্য তলব করেছিলেন। মার্কিন সাময়িকী পলিটিকো তখন লিখেছিল, বারের এই পদক্ষেপের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে তার রাজনৈতিক আশ্রয় হারাতে পারেন এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোও হতে পারে।
সোমবার (১৪ আগস্ট) পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন কানাডায় অবস্থান করা আরেক খুনি নূর চৌধুরী সম্পর্কে বলেন, এ ব্যাপারে আমরা কানাডায় কেইসও করেছি। কেইসে জাজ রায় দিয়েছেন, তার অবস্থান বলতে কানাডা সরকারের কোনো আপত্তি থাকা উচিত না। তবুও কানাডীয় সরকার এই তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছায় নাই।
ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা এনসিবি কর্মকর্তারা বলছেন, এ দুইজনকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চললেও বাকি তিনজনের অবস্থানের ব্যাপারে কোনো তথ্যই মিলছে না।
প্রায় দুই বছর আগে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারে খবর এসেছিল যে পাঁচ পলাতকের একজন রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছেন। ওই খবর পেয়ে নড়েচড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সরকার, ভারতের এনসিবির কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রকাশিত খবরটি ‘সত্য নয়’।
পুলিশ সদর দপ্তর এবার বলছে, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের অবস্থান শনাক্ত না হলেও বর্তমানে তার সম্ভাব্য অবস্থান পাকিস্তান। বাকি দুইজনের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশীদ এবং সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরীফুল হক ডালিম কোথায় আছেন সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত এনসিবি বা গোয়েন্দারা নিশ্চিত হতে পারেনি।
পঁচাত্তরের সেই হত্যাকাণ্ডের খুনিদের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এই দুইজনের অবস্থানের ব্যাপারে কোনো তথ্যই নেই তাদের কাছে। তাদের অবস্থান শনাক্তকৃত নয়। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের ধারণা ডালিম পাকিস্তানে ও রশীদ জিম্বাবুয়ে অথবা দুইজনই লিবিয়ায় অবস্থান করতে পারে।
এনসিবি কর্মকর্তারা বলেন, পলাতক খুনিদের ব্যাপারে তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তাদের সবার নামেই ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছরের মাথায় ঘটে যাওয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে।
এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিলের রায়ে এদের মধ্যে তিনজন খালাস পান। যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত, তাদের একজন আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান বলে খবর আসে। বাকি ১১ জনের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন বন্দি অবস্থায় আদালতে রিভিউ আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যায়।
এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে। বাকি ছয়জন পলাতক থেকে যান। তার প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতক ছয়জনের একজন ৭২ বছর বয়সি মাজেদকে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেফতারের কথা জানায় সরকার।
তখন গোয়েন্দারা বলেছিলেন, মাজেদ এতদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়েছিলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর সময় দেশে ফেরেন।
পলাতক মাজেদের আপিলের সুযোগ ছিল না। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষার চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তা নাকচ হওয়ার পর কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ