রেলওয়ের গাফিলতিতেই দুর্ঘটনা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক>>>
ঢাকার লোকোশেডে ইঞ্জিন ঘোরানোর যন্ত্র (টার্ন টেবিল) বহুদিন নষ্ট। এ জন্য ইঞ্জিন উল্টো লাগিয়ে চালানো হয় পণ্যবাহী ট্রেন। এতে সিগন্যাল দেখতে চালকের সমস্যা হওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে টার্ন টেবিল দ্রুত মেরামতের তাগিদ দিয়ে গত রবিবার ঢাকার বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে (লোকো) চিঠি দেওয়া হয়। এর পরদিন গতকাল সোমবার ভৈরব স্টেশনের আউটারে যাত্রীবাহী এগারসিন্দুর গোধূলি এক্সপ্রেসে উল্টো ইঞ্জিনের পণ্যবাহী ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ গেছে অন্তত ১৭ জনের।
রেলওয়ে বলছে, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী পণ্যবাহী ট্রেনের চালকের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেলের পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেছেন, চট্টগ্রামগামী পণ্যবাহী ট্রেনটিকে স্টেশনের আউটারে থামতে সিগন্যাল দেওয়া হয়। লোকোমাস্টার (চালক) সংকেত অমান্য করে স্টেশনে ঢুকে পড়লে ভৈরব থেকে ঢাকামুখী যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষের তিনটি বগির সঙ্গে ধাক্কা লাগে।
শুধু চালকের ভুল নয়, গাফিলতি রয়েছে রেলওয়েরও। ভুল আর গাফিলতিতে ঝরে গেছে সাধারণ মানুষের প্রাণ। দুর্ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তাই প্রাণহানি বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনায় শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এগারসিন্দুরের আহত যাত্রীরা জানিয়েছেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট শব্দে ধাক্কা লাগে। সিটে বসা ছাড়াও বহু যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধাক্কায় তারা ছিটকে পড়েন; চাপা পড়েন বগির নিচে। এতে প্রাণহানি বেড়েছে।
রেল সূত্র জানিয়েছে, ৩০২৮ নম্বরের ইঞ্জিনে পণ্যবাহী ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন চালক জাহাঙ্গীর আলম। ২০০৪ সালে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর এ চালক ৬ বছর ধরে পণ্যবাহী ট্রেন চালাচ্ছেন। রেলের ইঞ্জিন সামনে-পেছনে দুই দিকে চলতে পারে। উল্টো করে লাগানোর কারণে ইঞ্জিনের পেছন দিক ছিল ট্রেনের সামনে আর চালকের বসার স্থান (ক্যাব) ছিল পণ্যবাহী কনটেইনারের কাছাকাছি। অর্থাৎ চালক সামনে থাকার পরিবর্তে বগির কাছাকাছি বসে ট্রেন চালাচ্ছিলেন।
একাধিক চালক জানান, এতে ‘লং হুড’ সমস্যা তৈরি হয়। অর্থাৎ ইঞ্জিনের লম্বা বডি সিগন্যাল এবং চালকের মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফলে চালককে সিগন্যাল দেখতে হয় দূর থেকে। তিন হাজার সিরিজের ইঞ্জিনের দৈর্ঘ্য অন্যান্য ইঞ্জিনের তুলনায় বেশি। এ ইঞ্জিনের দৈর্ঘ্য ১৯ হাজার ৬৯ মিলিমিটার বা প্রায় ৬৩ ফুট। চালকের ক্যাব বাদে দৈর্ঘ্য ৫৮ ফুট। ইঞ্জিন উল্টো করে লাগানোর কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ ফুট দূর থেকে সিগন্যাল দেখতে হয় চালককে।
রেল সূত্রের ভাষ্য, ভৈরবের দুর্ঘটনায় উল্টো ইঞ্জিনের একই সমস্যা ছিল। চালকের বরাতে তাঁর সহকর্মীরা জানিয়েছেন, লং হুড সমস্যায় আউটারে থামার সিগন্যাল চালক দেরিতে দেখেন। ব্রেক করতে দেরি হওয়ায় পণ্যবাহী ট্রেনের গতি কমলেও থামেনি। ট্রেনটি ধাক্কা দেয় এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসকে।
একাধিক রেল কর্মকর্তা জানান, চালকেরও ভুল রয়েছে। ভৈরব স্টেশনটি রেললাইন থেকে নিচু। এ জন্য স্টেশনে প্রবেশের আগেই সতর্কতা হিসেবে গতি কমাতে হয়। কিন্তু চালক জাহাঙ্গীর আলম তা করেননি। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা চালকের দায় দিয়ে বলেছেন, সিগন্যাল থাকে বাঁ দিকে। ইঞ্জিন উল্টো করে চালালেও চালকের দিকেই থাকে। বড়জোর ৫০ ফুট পরে দেখতে পাবেন। রেললাইনে মানুষের চলাচল দেখতে সমস্যা হলেও সিগন্যাল নজরে না পড়ার কারণ নেই।
দুর্ঘটনার পর চালক ও সহকারী চালক, ট্রেনের গার্ডকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে রেলওয়ে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উল্টো ইঞ্জিনের বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেছেন, কী কারণে দুর্ঘটনা, তা তদন্তে জানা যাবে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
একটি ভিডিও ক্লিপের সূত্রে জানা গেছে, পণ্যবাহী ট্রেনের বগির ডিস্ট্রিবিউটর ভাল্ভ (ডিভি) কাজ করেনি। তাই চালক ইঞ্জিনের ব্রেক কষলেও ডিভি কার্যকর না থাকায় বগির ব্রেক কাজ করেনি। এ জন্য ট্রেনটি থামেনি। ৩২টি বগির পাঁচটির ডিভি সচল পাওয়া গেছে দুর্ঘটনার পর।
গত রবিবার রেলের চট্টগ্রামের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) সাজিদ হাসান নির্ঝর স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, ‘ঢাকার লোকোশেডের টার্ন টেবিলটি নষ্ট। তাই লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) টার্ন (ঘোরানো) সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ২৬০০, ২৯০০ ও ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো পেছনের দিক সামনে রেখে ট্রেন চালাতে হয়। অনেক স্থানে নিরাপদ দূরত্ব থেকে সিগন্যাল ও লেভেল ক্রসিং দেখা যায় না’। টার্ন টেবিলটি দ্রুত মেরামতের তাগিদ দিয়ে চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বিশেষ করে ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলোর দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় এ ঝুঁকি আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। যে কোনো সময়ে সিগন্যাল ওভারশুট বা লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে’।
সাজিদ হাসান নির্ঝরের বক্তব্য জানতে পারেনি। ঢাকার বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মন্তব্য করেননি। টার্ন টেবিল কত দিন ধরে নষ্ট– প্রশ্নে তিনি টেলিফোন সংযোগ কেটে দেন। পরে আর ফোন ধরেননি। রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক বোরহান উদ্দিন বলেছেন, টার্ন টেবিল নষ্ট থাকার বিষয়ে তাঁর জানা নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক এবং কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর ও আশুগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল বেলা সোয়া ৩টার দিকে এগারসিন্দুর ট্রেন ভৈরব স্টেশন থেকে ছাড়ে। এর কয়েক মিনিট পর বিপরীত দিক থেকে পণ্যবাহী ট্রেন ডাবল লাইনের অপর লাইন দিয়ে ঢুকে পড়ে। ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, ‘ক্রস ওভার’ করে পণ্যবাহী ট্রেনটি ঢোকে।
ভৈরব স্টেশনমাস্টার মো. ইউসুফ জানান, যাত্রীবাহী ট্রেনের তিনটি বগি দুমড়েমুচড়ে রেললাইন থেকে ছিটকে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে স্থানীয়রা উদ্ধারকাজ শুরু করেন; বগির নিচে আটকে পড়াদের বের করে আনেন। এ সময় আহত ও স্বজনের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। পুলিশ, র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিস এসে আহতদের ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে নিয়ে যায়।
কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার আবুজর গিফারী জানিয়েছেন, ময়মনসিংহ, নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও উদ্ধারে অংশ নেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে উদ্ধারকারী ট্রেন এসে কাজ শুরু করে।
স্থানীয় এমপি নাজমুল হাসান পাপন দুর্ঘটনাস্থলে যান। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ উদ্ধারকাজ তদারকি করেন। নিহতদের স্বজনদের ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের টং দোকানদার ফাতেমা বেগম (৬০) ও স্থানীয় ভৈরবপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল গণি বলেন, বিকট শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি মানুষের ছোটাছুটি ও আহতদের আর্তনাদ।
করিমগঞ্জের আলমগীর হোসেন মাথা, বুক ও পায়ে রক্তাক্ত আঘাত এবং প্রতিবেশী রায়হান ভাঙা হাত নিয়ে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তারা জানান, দুর্ঘটনায় তাদের বগি রেললাইন থেকে ছিটকে পড়ে ফাঁক হয়ে যায়। অনেকেই চোখের সামনে চাপা পড়ে ছিল। কেয়ামত মনে হয়েছিল।
বাজিতপুর হাসপাতালের চিকিৎসক শাহরিন খানসহ ১০ জনকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শাহরিন এগারসিন্দুর ট্রেনে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। গুরুতর আহত অনেককে ঢাকার হাসপাতালেও পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংবাদ বিজ্ঞাপ্তিতে জানিয়েছে, কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে ১৫ চিকিৎসক ছাড়াও কয়েকজন চিকিৎসা কর্মীকে দুর্ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। হতাহতদের উদ্ধারে ১০টি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪০ জন চিকিৎসক কাজ করছেন। সেখানে ৭৫ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাদের ২২ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন মো. সাদেক এগারসিন্দুর ট্রেনের যাত্রী ছিলেন। তিনি জানান, ট্রেন ছাড়ার ৫ মিনিট পর একটা শব্দ হয়। প্রথমে মনে হলো, একটা ট্রেন যাচ্ছে। তারপর ঝড়ের মতো মনে হলো। এরপর চিৎকার আর কান্নার শব্দ। জ্ঞান ফিরে দেখেন, বগির ভেতরে অনেকের ওপরে পড়ে আছেন। পাশে থাকা বন্ধু তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনেন।
ট্রেনযাত্রী কুলিয়ারচর উপজেলার আগরপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের সজীব মিয়া (২৫) বলেন, হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো ট্রেনটি কেঁপে ওঠে। এরপরই ট্রেন বাম দিকে কাঁত হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন– সুজন মিয়া, তাঁর স্ত্রী ফাতেম (২৮) এবং দুই ছেলে সজীব (১৪) ও ইসমাইল (১০)। পরিচয় নিশ্চিত হওয়া অন্যরা হলেন– ভৈরব পোস্ট অফিসের সহাকারী পোস্টমাস্টার হুমায়ুন কবির জাহাঙ্গীর (৫৫), জেলার রাধানগর গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে আফজাল হোসেন (২৩), করিমগঞ্জ উপজেলার নজরুল ইসলামের স্ত্রী হোসনা আক্তার, কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের জিল্লুর রহমানের ছেলে হুমায়ুন কবির, বাজিতপুর উপজেলার ভুইয়াগাও গ্রামের আব্দুল হাইয়ের ছেলে আছির উদ্দিন, ভৈরবের উত্তর রানীবাজার গ্রামের প্রধান শীলের ছেলে সবুজ চন্দ্র শীল, শ্রীনগর গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে রাব্বী, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার চানপুর গ্রামের চান মিয়ার ছেলে সাইমন মিয়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বরইছাড়া গ্রামের মৃত সুরত বালীর ছেলে নিজাম উদ্দিন সরকার।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ