চান্দগাঁওয়ের বি ব্লকেই ৪৩ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান!

মাসুম রানা, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বি ব্লক যেন শিক্ষাখাতের এক নব্য বাণিজ্যিক এলাকা। যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও গিন্ডারগার্টেন। নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও আদতে যেন এগুলো এক একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান পণ্য ‘শিক্ষা’।
মূলত কর্মব্যস্ত নগরীর কর্মব্যস্ত নাগরিকদের টার্গেট করেই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠাননামীয় ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে বলে শিক্ষাবিদদের অভিমত। এতে করে প্রাথমিক থেকেই গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশু-কিশোররা।
আভিজাত্য ও বিলাসিতার দিক দিয়ে চান্দগাঁও এলাকাটি বেশ পরিচিত। এই আভিজাত্য ও বিলাসিতাকে পুঁজি করে এবং কর্মব্যস্ত নাগরিকদের টার্গেট করে শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে অসংখ্য কিন্ডার গার্টেন, স্কুল ও কলেজ এবং নূরানী মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেই কিন্ডার গার্টেনের মত প্লে থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হচ্ছে। আর কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসএসসি পর্যন্ত পড়ানোর কথা বলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়াচ্ছে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিতে। এতে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা থেকে জটিলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থীকেই মারাত্মক অনিশ্চয়তায় পড়তে হচ্ছে প্রতিবছরই। এ কারণে অনেকেই ঝড়ে পড়েছে শিক্ষা থেকে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ১৪টি সড়ক নিয়ে গড়ে ওঠা বি ব্লকে এই ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই মোট ৪৩টি। এরমধ্যে কিন্ডার গার্টেন ৮টি, স্কুল ও কলেজ ১১টি এবং নূরানী মাদ্রাসার সংখ্যা ২৪টি। তাছাড়া কোচিং সেন্টার রয়েছে ৯টি। প্রতিবছর এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যার বেশিরভাগই গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে।
এসব প্রতিষ্ঠানে সার্টিফিকেট বাণিজ্য থেকে শুরু করে চুক্তিতে শিক্ষার্থীকে মোটা অংকের টাকায় অন্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে পরীক্ষা দেয়াতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা প্রতিটি দেশে জন্মগ্রহণকারী নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু অসাধু ব্যক্তি ও দুষ্টুচক্র মিলে শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করেছে। এখানে বিনিয়োগে লাভ ছাড়া ক্ষতির শঙ্কা একেবারেই নেই বললেই চলে। ফলে অনেক জাল সার্টিফিকেটধারী ব্যক্তিও এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রধান শিক্ষক/অধ্যক্ষ বনে শিক্ষা বাণিজ্য করছেন। এসব কাজে যেন বাধাবিঘœ না ঘটে সে জন্য করা হয়েছে সংগঠনও।
ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরের শুরুতেই ভর্তি ফি ও বেতনসহ বিভিন্ন নামে অভিভাবকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। বাড়তি গাইড বই, খাতা, কলমও কিনতে হয় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রতিমাসেই নেয়া হয় উন্নয়ন ফি বাবদ অর্থও।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় অবস্থিত এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুরো সর্বনি¤œ ভর্তি ফি ১০০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬০০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। মাসিক বেতন সর্ব নি¤œ ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০০০ টাকা পর্যন্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯৯ শতাংশেরই নেই কোনো স্থায়ী ভবন। প্রায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলে ভাড়া বাড়িতে। কয়েকটি রুম ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বেশির প্রতিষ্ঠান। প্লে গ্রুপের স্কুলের ক্ষেত্রে রুমের সংখ্যা ২ থেকে ৩টি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা যেমন অপ্রতুল; তেমনি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম। সারা বছর ধরেই চলে ভর্তি কার্যক্রম।
উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অধিকাংশের সাথেই প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমের কোনো মিল নেই। ছোট ছোট শিশুদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য বইয়ের বোঝা। যেগুলো কিনতে হয় স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই। প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের বিরাট অংশ আসে এখান থেকেই।
এই এলাকার আশেপাশে পর্যাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এমপিওভুক্ত উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকা স্বত্ত্বেও ব্যক্তি মালিকানাধীন এই সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে চান্দগাঁও আবাসিকে বসাবসরত ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ কলেজের সহকারী শিক্ষক মাঈন উদ্দীন দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, ‘বাণিজ্যিক স্বার্থে গড়ে উঠা এই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি-নৈতিকতার চর্চার বালাই নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তাই গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আশেপাশে চাহিদার প্রেক্ষাপটে যতেষ্ট নিবন্ধিত সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারণে এসএসসিতে গিয়ে ঝড়ে পড়ছে অসংখ্য শিক্ষার্থী।
যদিও সরকার সাম্প্রতিক সময়ে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে তাতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর দৌরাত্ব কিছুটা কমে আসবে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও সরকার ‘কিন্ডারগার্টেন নীতিমালা’ এবং ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীতিমালা’ প্রণয়ন করার পরও কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশৃঙ্খলা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. আবুল বাসার দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই অনুমোদন ছাড়া গড়ে তোলা হয়েছে। যেগুলো আমাদের নীতিমালার আওতাভুক্ত করার জন্য কাজ চলছে। তবে আমাদের নিবন্ধিত কোনো প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের খবর পেলে আমরা সাথে সাথে ঐ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে থাকি’।
চান্দগাঁও এলাকার পশ্চিম উজানটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ হেফাজ উদ্দীন দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, ‘যেখান থেকে সততা ও মূল্যবোধের সঠিক পরিচয় শেখার কথা, সেখান থেকে ছোট শিশুরা শিখছে কিভাবে মানুষের সাথে প্রতারণা করতে হয়। কিভাবে জাতির সাথে প্রতারণা করতে হয়’। তিনি আরও বলেন, ‘এসব কারণে শিক্ষকরা হারাচ্ছেন তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা। যেখানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের টাকার গোলাম সেখানে মান-সম্মানের প্রশ্নইতো অবান্তর’।

ডিসি/এসআইকে/এমআর