আজমল হোসেন, মিরসরাই প্রতিনিধি >>>
মানুষের বাড়ির নাম বাদুড় বাড়ি। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এমন একটি বাড়ির অস্তিত্ব রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম মাস্টারপাড়া। সে গ্রামের মন্টুবাবুর বাড়ি যেন পশু-পাখিদের নিরাপদ অভয়ারণ্য। বাড়ির চারপাশের গাছগাছালিতে নির্বিঘ্নে ঝুলে আছে হাজার হাজার বাদুড়। একদিন-দু’দিন ধরে নয়, বাড়ির চারপাশ বেষ্টিত গাছপালাগুলোকে তারা তাদের অভয়ারণ্যে পরিণত করে এখানেই বসবাস করছে প্রায় দু’শ বছর ধরে। বাড়িটির প্রকৃত নাম মন্টু বাবুর বাড়ি। বর্তমানে যেটি বাদুড় বাড়ি নামে সর্বাধিক পরিচিত।
হাজার হাজার বাদুড় গাছের ডালে ডালে একসাথে ঝুলে থাকার দৃশ্য মনের কোণে জন্মায় অন্যরকম এক রোমাঞ্চ। ভাবুক মনে জাগিয়ে তোলে নানা ভাবনা। বিশেষ কোনো ঋতুতে বা সময়ে নয়, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত- এককথায় বছরের পুরো সময়টা এরা এখানে ঝুলে থাকে অভিন্নভাবে। তবে বর্ষা মৌসুমে তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যক বাদুড় দেখা যায়।
ভোর বেলা পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে এ বাড়ির মানুষের ঘুম ভাঙে বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দে আর কোলাহলে। শুনতে বিদঘুটে ও আশ্চর্যের মনে হলেও এ বাড়ির লোকেরা এমন পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে অভ্যস্ত। এ নিয়ে তাদের কোনো বিরক্তি নেই, নেই অভিযোগ-অনুযোগও। বাড়ির নিজস্ব নাম রেখে বাদুড় বাড়ি বললেও বিরক্ত কিংবা রাগান্বিত হন না এ বাড়ির মানুষেরা। বরং তারা মনে করেন- বাড়িতে বাদুড় থাকা সৌভাগ্যের চিহ্ন।
যে বাদুড় নিয়ে পাঠককূল পড়ছেন আসুন সে বাদুড় সম্পর্কে একটু জানা যাক। বাদুড় কোনো পাখি নয়। মানুষের মতোই স্তন্যপায়ী প্রাণী। তবে মজার ব্যাপার হলো তারা পাখার সাহায্যে অবলীলায় আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে। বলা হয় বাদুড়ই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা উড়তে সক্ষম। বাদুড় নিশাচর। তারা দিনের বেলা ঘুমিয়ে কাটায়। এসময় তারা গাছে গাছে ঝুলে থাকে। বাদুড় চলাফেরা ও শিকারে বের হয় রাতে। বলতে গেলে বাদুড় অন্ধই। চলাফেরা জন্য একে শব্দ তরঙ্গের উপর নির্ভর করতে হয়। চলার সময় বাদুড় প্রায় ২০ কিলোহার্টজ শব্দোত্তর তরঙ্গ সৃষ্টি করে এবং সে তরঙ্গ চারপাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। বাদুড় সে প্রতিধ্বনি থেকেই আশেপাশের সম্ভাব্য বাধা বিপত্তি সম্পর্কে ধারণা লাভ করে এবং নির্বিঘ্নে পথ চলে।
স্বভাবমতোই সারাদিন মানুষ যখন কর্মব্যস্ত, বাদুড়রা তখন নিগূঢ় ঘুমে মজে থাকে বাদুড় বাড়ির গাছগাছালিতে। দেখলে মনে হয় নাম না জানা কোনো ফল থোকায় থোকায় ধরে আছে প্রতিটি গাছে। সন্ধ্যে নামতেই তৎপর হয়ে উঠে বাদুড়রা। সন্ধ্যায় মানুষ যখন ঘরে ফিরে, বাদুড়রা তখন খাবার খোঁজার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সারারাত শিকারের খোঁজে বেড়িয়ে ভোর হতে না হতেই ফিরে এসে দলবেঁধে ঝুলে পড়ে মন্টু বাবুর বাড়ির গাছে। কড়ই, ইউক্যালিপটাস, বাঁশঝাড় সবই দখলে নিয়ে রেখেছে বাদুরেরা। পাখি প্রেমী এ বাড়ির মানুষরাও সহানুভুতিশীল এদের প্রতি। নিজেরাও কোনো কারনে বাদুড়ের উপর আক্রমণ করেন না এবং কাউকে আক্রমণ করতেও দেন না। বাদুড়গুলোর সাথে এ বাড়ির মানুষগুলোর বংশ পরম্বপরায় যুগ যুগ ধরে যেন আত্মার আদিম মিল। ঝড়, তুফানসহ কত প্রাকৃতিক দুর্যোগ গেলো এ বাদুড়গুলোর উপর দিয়ে। নানা প্রতিকূল অবস্থাকে পেছনে ফেলে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে এরা টিকে আছে এ বাড়ির গাছগুলোতে।
বাদুড় বাড়ি নামে পরিচিত সে বাড়ির মানুষজনের সাথে কথা বলে মিলেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। তবে ঠিক কখন থেকে এ বাড়ির গাছে বাদুড়রা বাসা করা শুরু করে তা কেউই সঠিক ও নির্ভরযোগ্যভাবে বলতে পারেননি। এ বাড়ির বাসিন্দাদের ধারণা- প্রায় ২০০ বছর ধরে এ বাড়িতে বাদুড়েরা তাদের অভয়ারণ্য হিসেবে এ বাড়িকে বেছে নিয়েছে।
এ বাড়িরই এক বাসিন্দা নিহার কান্তি রায়। পেশায় ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। বাদুড়বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে তার সাথে কথা বলে জানা যায় বিভিন্ন তথ্য। তার ভাষ্যমতে, লোকমুখে বাদুরকে রক্তচোষা হিসেবে শুনলেও প্রকৃতার্থে বাদুড় শান্ত নিরীহ প্রাণী। নিজের খাদ্যের চাহিদা মেটানো ছাড়া এরা মানুষের আর কোনো ক্ষতি করতে কখনো দেখা যায়নি। এ বাড়িতে বাদুড় যেমন নিরাপদে বসবাস করছে তেমনি বাদুড়ের কারনে এ বাড়ির মানুষের শান্তি নষ্টের মতো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা কখনোই ঘটেনি। শান্তভাবেই তারা সন্ধ্যা নামতে না নামতেই বেরিয়ে পড়ে, ফিরে আসে ভোর হতে না হতেই।
বাদুড়ের জীবনযাত্রাও বড় অদ্ভুত। মানুষের মতো কথা বলতে না পরলেও বাদুড়কে সামাজিক জীব হিসেবেই অনুমান করেন তিনি। কেননা এ বাদুড়গুলো যুগ যুগ ধরে তাদের বাড়ির গাছগুলোতে বসবাস করছে সমাজবদ্ধভাবে। তিনি আরো জানান, বাদুড়ের পাশাপাশি অন্য প্রজাতীর পাখিরাও বাস করে তাদের বাড়িতে। ঘুঘু, কাক, শালিক, ডাহুক, পানকৌড়ি, দোয়েল, মাছরাঙা, চড়–ইসহ আরো নাম না জানা বহু পাখি বাস করছে তাদের বাড়িকে কেন্দ্র করে। তার মধ্যে সংখ্যায় সর্বাধিক ও বেশিদিন ধরে বাস করে আসছে বাদুড়। প্রাথমিক দিকে এ বাদুড়গুলো সংখ্যায় খুব বেশি ছিলোনা। তবে ক্রমান্বয়ে বংশবিস্তারের কারণে এখন এ বাড়িতে হাজার হাজার বাদুড়ের বাস। বাদুড়কে ঘিরে সে বাড়িতে দানা বেধেছে গ্রাম্য কুসংস্কারের। বিশেষ করে বাড়ির মুরুব্বিরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, বাদুড় তাদের জন্য সৌভাগ্যের চিহ্ন। কোনো কারণে বাদুড় চলে গেলে সাথে তাদের ভাগ্যও চলে যাবে। দুর্ভাগ্য নেমে আসবে সবার জীবনে।
মাঝে মধ্যে বাদুড় বেশ চেঁচামেচি করে। তাদের চিৎকারে বাড়িশুদ্ধ লোক অতিষ্ট হয়ে উঠে। তারপরও সৌভাগ্য হারানোর ভয়ে তারা কেউ বিরক্ত হয়ে ‘উহ্’ শব্দটুকুও করে না।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- এ বাদুড়গুলোর জন্য কোনো বাসা নেই। অন্য পাখিরা যেমন বাসা তৈরি করে তাতে বসবাস করে, বাদুড়ের জীবনযাত্রা সেরকম নয়। তাদের জীবনধারনের জন্য বাসা তৈরি করার দরকার পড়ে না। অন্তত এ বাড়িতে বাসরত হাজার হাজার বাদুর দেখে তেমনই ধারণা করা হয়। কোনো বাসা ছাড়া প্রচুর ডালপালা সম্পন্ন গাছের মগডালে তারা স্বচ্ছন্দে ঝুলে থাকে। ঝুলন্ত অবস্থাতেই তারা ঘুমায়। তন্দ্রার ঘোরে তার ঝড়ে পড়ে যায় না বা কখনো পড়ে যেতে দেখা যায় না এসব বাদুড়দের। বাদুড়েরা স্তন্যপায়ী বলে তারা ডিম দেয় না। সরাসরি মানুষের মত বাচ্চা প্রসব করে। জন্মের পরপরই এ বাচ্চাগুলো মায়ের বুক আঁকড়ে ধরে আশ্রয় নেয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- একটি বাদুড়ছানাও নিচে পড়ে যায় না। এমনকি এ বাড়িতে হাজার হাজার বাদুড় বাস করলেও কখনো একটি মৃত বাদুড়ও নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। কোথায় যায় মৃত বাদুড়ের দেহ তা এক আশ্চর্য রহস্যই থেকে গেলো।
ডিসি/এসআইকে/এএইচ