ফেনীর বাতাস অতিরিক্ত বিষাক্ত, বলছে গবেষণা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
ফেনীর বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে।  বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে।  ক্যাপসের গবেষণায় অতিরিক্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশের ১৮টি জেলাকে, তার মধ্যে ফেনীও রয়েছে।  ক্যাপসের এ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।  এই অতিরিক্ত বায়ু দূষণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর।  ক্যাপসের ৮১ সদস্যের একটি গবেষক দল দেশটির ৬৪ জেলার তিন হাজারের বেশি স্থানের বায়ুর অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মান পরীক্ষা করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।  আদর্শমাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান।  গবেষণায় বলা হয়েছে, উপকূলীয় এলাকার মধ্যে শুধুমাত্র পটুয়াখালীর বায়ুমান ভালো বায়ুর পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত কিন্তু ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালী বায়ুদূষণ মাত্রা অনুযায়ী অতিমাত্রার দূষণ এলাকার অন্তর্ভুক্ত।
ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০২ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম, যা দৈনিক আদর্শ মানের চেয়ে প্রায় ১ দশমিক ৫৭ গুণ বেশি।  এর মধ্যে গাজীপুর জেলায়, যেখানে সবচেয়ে বেশি দূষণ পরিলক্ষিত হয়েছে সেখানে বায়ুর যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম।
এই অতিরিক্ত বায়ু দূষণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর বলছেন বিশেষজ্ঞরা।  এমন পরিস্থিতিতে বায়ুদূষণ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে স্বল্প/মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ১৫ দফা সুপারিশ করেছেন গবেষকেরা।  এর মধ্যে রয়েছে শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছোটানোর ব্যবস্থা করা, নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঢেকে রাখা, নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেয়া, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, অবৈধ ইট ভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা।  প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।  এছাড়া গাছ লাগানো, ছাদ বাগানে উৎসাহিত করা, জলাধার সংরক্ষণ সেই সঙ্গে নির্মল বায়ু আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে বাজেট ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এসব জেলায় বায়ুদূষণ বেশি ও কম হওয়ার কারণ হিসেবে গবেষক দল তাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছে যে, সবচেয়ে দূষিত শহরে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজ ও সমন্বয়হীন সংস্কার কাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।  এছাড়া আশেপাশের ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো সেখানকার দূষণের অন্যতম কারণ বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
ঝুঁকিতে প্রজনন স্বাস্থ্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে।  এর আগেও বায়ুর মানের সূচকে বাংলাদেশ বিশেষত ঢাকা শহর কয়েক দফা সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে উঠে এসেছে।
বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে-তার অধিকাংশই বায়ু দূষণজনিত।  গবেষণা বলছে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের কয়েকটি শহরে বায়ু দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেখানে বসবাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।  এই অতিক্ষুদ্র কণা এতোটাই ক্ষুদ্র যে এটি সহজেই মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে রক্তের সাথে মিশে যায় এবং ফুসফুস, হার্ট, কিডনি লিভার আক্রান্ত করে থাকে।
তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। বিশেষ করে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ু দূষণ বড় ধরণের প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক রাশিদা বেগম।  তিনি বলেন, বায়ু দূষণ, সার্বিকভাবে পরিবেশ দূষণের এক ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর।  এতে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছে, শুক্রাণুর মান কমে যাচ্ছে।  অন্যদিকে মেয়েদের ডিম্বাণু কল্পনাতীতভাবে কমে গিয়েছে।  আবার যেসব ডিম্বাণু রয়েছে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এসব দুর্বল বা নষ্ট ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর যখন নিষেক ঘটে এতে যে ভ্রূণ তৈরি হয় সেটা গর্ভে জায়গা করতে পারে না, আবার জায়গা করতে পারলেও বাঁচে না, গর্ভপাত হয়ে যায়।  আর এই সমস্যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বর্তাতে পারে, বলেন রাশিদা বেগম।
কমছে গড় আয়ু
গত বছরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইন্সটিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে বলা হয়েছে যে, বায়ু দূষণের কারণে সারা বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস।  ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস।
এছাড়া বায়ু দূষণের ফলে গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া বা সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পুরো প্রাণীজগতের ওপর পড়ছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের কারণে খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে উদ্ভিদ নিজেও বিপদে পড়ে এবং উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরাও বিপদে পড়ে।  এছাড়াও উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়।  উদ্ভিদের জৈবনিক প্রক্রিয়া ঠিক না থাকলে পৃথিবীতে খাদ্য শৃঙ্খল ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে বলে তিনি মনে করেন।
এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের নির্দেশ পরিবেশ অধিদফতরের
ফেনীতে বায়ু দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।  এ তথ্য জানিয়েছেন অধিদফতরের ফেনী কার্যালয়ের পরিদর্শক ফয়জুল কবির।  তিনি জানান, অন্য সময়ের তুলনায় শীতকালে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ধুলোবালি বেড়ে যায়।  ফলে বায়ু দূষণের মাত্রাও বেড়ে যায়।
বায়ু দূষণ বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, পুরো জেলাতে ১০৮টি ইটের ভাটা রয়েছে এবং বেশ কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকায় ফেনীর বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।  তবে যেসকল প্রতিষ্ঠানের কারণে বায়ু দূষণ বাড়ছে, সেগুলোকে এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।  তাতেও যদি বায়ু দূষণের মাত্রা না কমে তাহলে প্রতি তিন চার মাস অন্তর অন্তর সেকল প্রতিষ্ঠানে এন্টিএম পরীক্ষা করা হবে।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ