বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে ৭ জনে ১ জন!

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
নদীভাঙনের কারণে গত বছরের ২১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জে দুটি ঘর বিলীন হয়ে যায়।  যার ফলে আট জন মানুষের বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটে।  এর মাত্র কয়েক দিন আগে (১৩ নভেম্বর) রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাঁধ ভেঙে অন্তত ২৫টি ঘর ভেসে গেছে।  যার ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১১৫ জন।  বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রের তথ্য বলছে, আগামি ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতি ৪৫ জনে একজন এবং বাংলাদেশে প্রতি সাত জনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হবে।  অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইএমডিসি) হিসাব অনুযায়ী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা আইডিএমসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে।  যাদের মধ্যে অনেকেই এরই মধ্যে আবাস গড়লেও ৩ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ এখন পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত।  ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট’ অনুযায়ী বিশ্বে বাস্তুচ্যুতির ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়।  প্রথম অবস্থানে আছে আফগানিস্তান।  আর গত ১১ বছরের তথ্য বলছে, এই সময়ে বাস্তুচ্যুতির ঘটনা বেড়েছে ৮ গুণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক দুর্যোগপ্রবণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় সময়ই বন্যা হয়ে থাকে।  আর আবহাওয়ার কারণে সারা বছরই এসবের প্রভাব থাকে বেশি।  এসব কারণে প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে।  ২০২০ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ৪৪ লাখ নতুন বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটে।  এর বেশিরভাগই সাইক্লোন আম্ফানের প্রভাবে হয়েছে।
আইএমডিসি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।  এসব বাস্তুচ্যুতির ঘটনাগুলো ছিল মূলত নদীভাঙন, বন্যা ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট হঠাৎ বন্যা ও জলাবদ্ধতা।  প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ১১টি জেলায় বাস্তচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে।  বাস্তুচ্যুতির এই ঘটনা ২০১৮ সালে প্রায় ৯ লাখ।
প্রতিবেদনের গত এক দশকের বাস্তুচ্যুতির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একই সংস্থার ২০১৯ সালের অর্ধবার্ষিকী প্রতিবেদনের হিসাব মতে, বাংলাদেশের ২৩টি জেলা থেকে প্রায় ১৭ লাখ মানুষকে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে।  এর বেশিরভাগই ঘটেছে বিভিন্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে, যেমন ভোলা, খুলনা ও পটুয়াখালী।  ২০১৩ সালের আদমশুমারির (২০১৩) ভিত্তিতে চালানো রামরু ও এসসিএমআর-এর ২০১৩ সালের যৌথ গবেষণার পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৬ থেকে ২৬ মিলিয়নের বেশি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে নিজ বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হবে।  ব্যাপক এই বাস্তুচ্যুতির ফলশ্রুতিতে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতরাসহ দেশে বিদ্যমান অন্যান্য ধরনের শ্রমিকরাও মূলত দেশের ভেতরেই অভিবাসিত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর মধ্যে আছে উপকূলীয় জেলা ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা। উপকূলীয় এলাকা বাদে আছে নীলফামারী, রংপুর, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, মুন্সীগঞ্জ ও রাজবাড়ী।  বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাস্তুচুত্যির সংকট জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের আন্ত-সরকার প্যানেল (আইপিসিসি)’র পঞ্চম সমীক্ষা প্রতিবেদনে ভবিষ্যানুমান অনুযায়ী, ২১ শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি থেকে ৪ দশমিক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে।  তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুসহ হিমালয়ের বরফ গলার পরিমাণও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে।  ভারতীয় উপমহাদেশে নদীর অববাহিকায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ তুলনামূলক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত।
আইপিসিসির গবেষণার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রকাশিত ‘গ্রাউন্ডসওয়েল: প্রিপেয়ারিং ফর ইন্টারনাল ক্লাইমেট মাইগ্রেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীব্যাপী ১৪ কোটি ৪৩ লাখ মানুষকে অভ্যন্তরীণ শরণার্থী জীবন বেছে নিতে হবে।  এরমধ্যে আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চলের ৮ কোটি ৬০ লাখ মানুষ, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৪ কোটি এবং লাতিন আমেরিকার ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ভবিষ্যতে এই বাস্তুচ্যুতির শিকার হবে।  পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশের ৫৫ ভাগ মানুষ এই এলাকাগুলোতে বাস করে।  ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এখানে বন্যা, ভূমিধস এবং আকস্মিক বন্যার মতো দুর্যোগ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।  আইপিসিসির গবেষণা বলছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৭-২০ শতাংশ স্থলভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে।  জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রণীত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা বিসিসিএসএপি ২০০৯ অনুসারে এর ফলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর প্রভাবে বাস্তুচ্যুতির এই ঘটনা প্রায় ৮০ ভাগ কমানো সম্ভব, এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ।  প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে গ্রাম থেকে শহরে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসার বিষয়টি বিপজ্জনক আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় সবগুলোই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে।  আমরা দুইভাবে এ বিষয়ে কাজ করছি।  প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস।  জলবায়ু মোকাবিলা করার জন্য কপ সম্মেলনে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে– কার্বন নিঃসরণ কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা; সেদিকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।  যেমন– আমাদের পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে বলা হয়েছে ১০-৩০ শতাংশ সোলার করার জন্য।  ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎচালিত যানবাহন করার কথা বলা হয়েছে, বনায়ন করতে বলা হয়েছে।  এসব কাজ করলে আমাদের কার্বন নিঃসরণ কমলে, ওজন স্তর নিরাপদে থাকবে, তাপমাত্রা কমবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্রাস পাবে।
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয়ত দুর্যোগে যাতে ক্ষয়ক্ষতি না হয়, বাংলাদেশ যাতে একটি দুর্যোগ সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হতে পারে, সেজন্য সরকার ডেল্টা প্ল্যান হাতে নিয়েছে।  সেখানে এক এক এলাকার ঝুঁকি এক একভাবে কমিয়ে আনার পরিকল্পনা আছে।  তার সঙ্গে আছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।  এগুলো হয়ে গেলে বাংলাদেশ দুর্যোগ সহনীয় রাষ্ট্র হয়ে যাবে।  জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্থায়ীভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমেই কিন্তু বাস্তুচ্যুতি কমে আসবে।  এ নিয়ে অনেক অংশীদাররা গবেষণা করেছেন।  সেখানে তারা আমাদের একটি পরিকল্পনা দিয়েছেন।  সেই পরিকল্পনা আমরা আমাদের কর্মসূচির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছি এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করছি।  বাস্তুচ্যুতি কমিয়ে আনতে আলাদাভাবে পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হয়েছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, দুর্যোগ কমানোর ব্যবস্থা তো আমাদের হাতে নেই।  আমাদের মতো দেশের তো সেই সক্ষমতা নেই।  আমি মনে করি আমাদের পরিবেশ ঠিক রাখা, একটা দেশে যে পরিমাণ বনভূমি থাকা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা, নদীভাঙন রোধ করা, মানুষ যাতে বাস্তুচ্যুত না হয় তা রোধ করা।  আমরা সেগুলো করতে পারলে একটা কাজ হতো।  আমরা বন উজাড় করছি, নদী নালা খাল দখল করছি, ঢাকার চারপাশে নদীগুলোর অবস্থা কিন্তু ভালো না।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, সামনের দিনগুলোতে দুর্যোগ আরও বাড়বে।  আমাদের জাতীয় কৌশলের পাশাপাশি অ্যাডাপ্টেশনের দিকেও নজর দিতে হবে।  জলবায়ুর কারণে যে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন হয় একেক এলাকায়, কিন্তু এগুলোর ধরন একই।  আমরা একেক জায়গার জন্য যেন আলাদা কৌশল নির্ধারণ করি।  শুধু কৌশল নিলেও হবে না, তার সঙ্গে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।  না হলে আগামী দিনগুলোতে বড় সমস্যা হয়ে যাবে।  এজন্য বাস্তুচ্যুতি কমিয়ে আনতে সবার একটি সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার প্রয়োজন আছে। খবর সূত্র- বাংলাট্রিবিউন

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ