তার সম্পদ রক্ষায় সৈন্য ছিল দুই লাখ!

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
টাকা-পয়সা যদি হাতের ময়লা হয়, তাহলে পৃথিবীতে কার হাত সবচেয়ে বেশি নোংরা হতে পারে?  এ প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই কয়েকজনের নাম আসবে ইলন মাস্ক, বিল গেটস, জেফ বেজোস এর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের।  তবে তারা কেউই সর্বকালের সবচেয়ে বেশি ধনী ব্যক্তি নন।  সর্বকালের শীর্ষ ধনী হিসেবে সামনে এসেছেন ১৪ শতকের পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির এক শাসক মুসা।  মানসা মুসা নামে তিনি অধিক পরিচিত।
মানসা অর্থ রাজা বা সম্রাট।  এটি তার নামের অংশ নয়, উপাধী।  মুসার পুরো নাম ‘প্রথম মুসা কিতা’।  পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির সুলতান হওয়ার কারণে তাকে মানসা খেতাবে ভূষিত করা হয়।  মানসা ছাড়াও কমপক্ষে আরও ডজনখানেক উপাধী ছিল তার।  তাকে প্রথম মুসা, মালির আমির, ওয়াংগারা খনির সম্রাট, কনকান মুসা/কানকো মুসা, মালির সিংহ, গঙ্গা মুসা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
মুসার জন্ম ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে।  তিনি ছিলেন মালি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সান্দিয়াতা কিতার ভাগ্নে।  তার বড় ভাই আবু-বকরের পর মুসা মালির রাজা হন ১৩১২ খ্রিস্টব্দে।  তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর।  এ বয়সেই তিনি পৃথিবীর বড় একটা অংশের সম্রাট ছিলেন।  তিনি প্রথম আফ্রিকান শাসক, যিনি ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন।
ইতিহাস বলছে, তার শাসনামলে মালি সাম্রাজ্যের শান-শওকত ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।  তৎকালীন রাজধানী তিম্বুকতুসহ ২৪টি নগর যুক্ত করে মালি সাম্রাজ্য গঠন করা হয়।  মুসা বর্তমান সময়ের মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার, নাইজেরিয়া, চাদ, আইভরি কোস্টসহ ২৪টি শহর এবং এদের আশেপাশের গ্রামাঞ্চল সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জয় করেন।
২০১২ সালে মার্কিন ওয়েবসাইট সেলিব্রিটি নেট ওয়ার্থের হিসাবে আজকের বাজারে আনুমানিক ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মালিক ছিলেন মুসা।  এদিকে গত বছর পর্যন্ত বেজোসের সম্পদের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার কোটি ডলার।  স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, মুসা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী হলেন কীভাবে?
১৪ শতকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী তিনটি অঞ্চলের একটি ছিল পশ্চিম আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্য।  এর কারণ, তামাম দুনিয়ায় যত সোনা উত্তোলন এবং লবন আহরণ হতো তার অর্ধেকটাই ছিল মালি সাম্রাজ্যে।  ভাবুন তো, পৃথিবীর উত্তোলিত অর্ধেক সোনার মালিকানা একজন মানুষের কাছেই!  এই সোনা আর লবণের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন মানসা মুসা।
মুসার যে বিশাল সাম্রাজ্য সেখান থেকে নিয়মিত খাজনা সংগ্রহ করতেন তিনি।  তার সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকার মধ্যবর্তী এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক পথ।  এই পথে বাণিজ্য করতে আসা মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও রাজস্ব আদায় করতেন দক্ষ এই শাসক।  এভাবেই দিনে দিনে তার সম্পদ, ঐশ্বর্য এতটাই বেড়ে যায়, যা তাকে সর্বকালের সেরা ধনী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যথেষ্ট’র চেয়েও অনেক বেশি।
সম্পদ অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।  কিন্তু মুসার সম্পদ এবং সাম্রাজ্য দুটোই রক্ষা করার জন্য ছিল বিশাল এক বাহিনী।  অনেকটা আজকের দিনের সেনাবাহিনীর মতোই।  তার এই বাহিনীর সদস্য ছিল দুই লাখ!  যার মধ্যে ৪০ হাজার সৈন্য ছিলেন তীর চালনায় অতি দক্ষ।
মানসা মুসা এমনই বিলাসিতা দেখিয়েছেন যে, তাকে ঘিরে অনেক গল্প আছে।  তার মধ্যে হজ করতে যাওয়ার গল্পটি সুবিদিত।  মালির এই শাসক মনে করতেন, ইসলামে প্রবেশ মানে হচ্ছে একটি সভ্য সাংস্কৃতিক দুনিয়ায় পদার্পণ।  নিজের সাম্রাজ্যের মধ্যে ধর্ম প্রসারের কাজেই বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতেন তিনি।  ১৩২৪-২৫ সালের মধ্যে হজ করতে গিয়েছিলেন মুসা।  ওই সময় তার সঙ্গে ছিল ৬০ হাজার মানুষ।  এদের মধ্যে ১২ হাজার ছিল সেবক।
এসব সেবকের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল একটি করে সোনার বার।  এছাড়া ৮০ থেকে ১০০টি উট ছিল বহরে, যেগুলো প্রত্যেকটি প্রায় ১৪০ কেজি করে সোনা বহন করছিল।  যাত্রাপথে কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের সোনা বিতরণ করেন তিনি।  বলা হয়ে থাকে, ওই হজে মুসা আজকের দিনের প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড ওজনের সোনা ব্যয় করেছিলেন।  যে কারণে এর পরের কয়েক বছর কায়রো, মক্কা এবং মদিনায় সেখানে সোনার দাম একেবারেই নেমে গিয়েছিল।  এতে অবশ্য শহরগুলোর অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।  বেড়ে গিয়েছিল মুদ্রাস্ফীতি।
মুসার এই হজযাত্রায় সঙ্গী হন তার প্রথম স্ত্রী।  এছাড়া নিযুক্ত ছিলেন আরো ৫০০ সেবিকা।  কাফেলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষক, চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তা ও সংগীতশিল্পীও ছিলেন।  কথিত আছে, প্রতি জুমাবারে একটি করে মসজিদ নির্মাণ করতেন তিনি।  মক্কায় হজ পালনের পর আরব বিশ্বের একটি বড় অংশ ঘুরে বেড়াতে থাকেন এই পশ্চিম আফ্রিকান শাসক।
তখন মক্কাবাসীর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। ফেরার সময় সেখান থেকে বহু উট বোঝাই করে চিকিৎসা, জোতির্বিদ্যা, দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত এবং আইন বিষয়ে প্রচুর বই নিয়ে আসেন।  এছাড়া মক্কার সবচেয়ে মেধাবী এবং সেরা গণিতবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও স্থাপত্যবিদদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন মালিতে।  ইসলামি শিক্ষাভিত্তিক অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং নিজের সাম্রাজ্য থেকে উত্তর আফ্রিকার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষার্থী প্রেরণ করেন মুসা।
মক্কায় হজ পালনকালেই মুসা খবর পান, তার জেনারেল সাগমান্দিয়া গাও শহর দখল করেছে।  বিজয়ের পর শহরটি সফর করতে যান তিনি।  সেখানে গিয়ে গাও সম্রাটের দুই পুত্রকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেন এবং মালি সাম্রাজ্যের রাজধানী নিয়ানিতে নিয়ে আসেন।  তাদের দুই ভাইকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন।  মালির থিমবুকতু শহরকে বৃত্তিপ্রাপ্ত মুসলিমদের শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করেন এই সম্রাট।  একইসঙ্গে শহরটি হয়ে ওঠে বাণিজ্য এবং সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রও।  ভেনিস, গ্রানাডা এবং জেনোয়ার মতো ইউরোপীয় শহরগুলোতে যখন এই বাণিজ্যকেন্দ্রটির সংবাদ পৌঁছায় তখন সেখানকার ব্যবসায়ীরা দ্রুত এটিকে তাদের বাণিজ্যিক শহরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
মুসার সময় থিমবুকতু শহরের শাঙ্কোর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার আইন বিশেষজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদদের একটি মিলনমেলা।  ১৩৩০ সালে পার্শ্ববর্তী মোসি সাম্রাজ্য থিমবুকতু দখল করে নেয়।  সঙ্গে সঙ্গেই সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ পুনর্দখল করতে সক্ষম হন মানসা মুসা।
ওই শহরের রাজপ্রাসাদটি ধ্বংস হয়ে গেলেও এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদগুলো।  তার সময়েই লাইব্রেরি অব আলেকজান্দ্রিয়ার পর আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয় ইউনিভার্সিটি অব শাঙ্কোর।  সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২৫ হাজার আবাসিক শিক্ষার্থী বিদ্যার্জন করতো এবং পাঠাগারে ছিল এক লাখেরও বেশি বই।
টানা ২৫ বছর মালি শাসন করে ১৩৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে ধনী এই ব্যক্তি।  তবে তার মৃত্যুর সঠিক কোনো কারণ এখন উদ্ধার করতে পারেননি ইতিহাসবিদরা।  মৃত্যুর সাল নিয়েও আছে বিতর্ক।  ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুনের মতে, কমপক্ষে ১৩৩৭ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি।  ওই বছরই আলজেরিয়া বিজয়ে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন মুসা।

ডিসি/এসআইকে/আরএআর