জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও ঐতিহাসিকতা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী >>>
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের প্রথম সোপান জাতীয় পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে ভৌগোলিক সীমানাকে বেষ্টন করে থাকে এই পতাকা।  যে সব উপাদান রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পতাকা।  পতাকা থেকে রাষ্ট্রকে কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না।  বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দুজন বাঙালি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ঘটনায় জড়িত।  একজন ভারতের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আরেকজন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলক।  তারা দু’জনই স্বাধীনতার প্রশ্নে মানুষের অনমনীয় সংকল্প ও অদমনীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছেন।  অস্তিত্বের বাস্তবতায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাহসিকতাই তাদের ঐতিহাসিকতা।
একজন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আন্দামান নিকোবর দ্বীপের রাজধানী ‘পোর্ট ব্লেয়ারে’ ১৯৪৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর।  আরেকজন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।  ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন সংগ্রামী নায়ক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।  আর জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সংগ্রামী নায়ক আ স ম আবদুর রব।
বাঙালি জাতির ইতিহাসের সংগ্রহশালায় পতাকা উত্তোলনের এ দুটি ঘটনাই কেবলমাত্র সংরক্ষিত আছে।  নেতাজি উত্তোলন করেছিলেন তিরঙ্গা পতাকা আর আ স ম রব উত্তোলন করেছিলেন লাল সবুজের পতাকা।
একজন বৃটিশদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার জন্য নিজের দেশ ত্যাগ করেছেন এবং ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন।  আরেকজন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে নিজ দেশ ত্যাগ করে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন।  দুজনেরই সংগ্রামের লক্ষ্য এক- স্বাধীনতা।
একজন দেশমাতৃকার তরে ইহজীবন থেকে চিরতরে নিরুদ্দেশ হয়েছেন আরেকজন স্বাধীনতা অর্জনের পরও আজও স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরন্তর সংগ্রামে জড়িত আছেন।
নেতাজিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়, যিনি দুশো বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে আংশিক মুক্তির স্বাদ দেন।  বৃটিশের দখলে থাকা ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে প্রথম স্বাধীন বলে ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।  ভারতের আন্দামানই প্রথম বৃটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে।
সে সময় অবশ্য ভারতীয় জাতীয় পতাকা আজকের মতো ছিল না।  সময়ের সঙ্গে নানা ভাবে বদলেছে ভারতের জাতীয় পতাকা, একদম ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত।  ভগিনী নিবেদিতা পতাকা, লোটাস পতাকা, বার্লিন ফ্ল্যাগ সর্বশেষ তেরঙ্গা পতাকা।  ১৯৩১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভায় পতাকা চূড়ান্ত করা হয়।  আর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা চূড়ান্ত করা হয় নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে।
মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতীয় পতাকার অনুমোদন দিয়েছিলেন।  আর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে ও অনুমোদনে।
উল্লেখ্য, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসে ঘোষণা করেন, বছর শেষের আগেই ভারতের মাটিতে উপস্থিত হবে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’।  ১৯৪৩ সালের শেষের দিকে আজাদ হিন্দ সরকার জাপানিদের কাছ থেকে এই দ্বীপপুঞ্জের দখল নেয়।  নেতাজি সুভাষ বসু পোর্ট ব্লেয়ারে হাজির হন ২৯শে ডিসেম্বর এবং তার পরদিনই ৩০শে ডিসেম্বর প্রথমবার পোর্ট ব্লেয়ারে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
নেতাজির পতাকা উত্তোলনের ৭৭তম বার্ষিকী পালিত হয়েছে ৩০শে ডিসেম্বর ২০২০ আর আ স ম আবদুর রব-এর পতাকা উত্তোলনের ৫০ বছর পালিত হচ্ছে ২রা মার্চ ২০২১।
নেতাজি স্বয়ং ভারতের এই দ্বীপপুঞ্জে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে এক বিশাল জনসভায় দেশকে বৃটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।  সেই ঘোষণার চার বছর পরই ভারতমাতা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ লক্ষ ছাত্র-জনতার বিশাল জনসমুদ্রে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব পতাকা উত্তোলন করে বলেছিলেন আজ থেকে এটাই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।  পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে স্বাধীনতা উন্মুখ বাঙালি জাতির আকাঙ্ক্ষা।  দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।  পতাকা উত্তোলনের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকে কামান, ট্যাংক ও জলকামান সজ্জিত ছিল।  সে চিত্র ছিল খুবই ভয়াবহ।  মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কোটি কোটি বাঙালির স্বপ্নের পতাকা উত্তোলন করতে হয়েছিল।  স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার জন্য রক্ত লাল পতাকা উত্তোলন করা বিশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিতে এমন ঘটনা বিরল।  একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বুকে আরেকটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা চেয়ে পতাকা উত্তোলন করা অকল্পনীয় ঘটনা।
পতাকা উত্তোলনের ৯ মাস পর পাকিস্তানি দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ পতাকা উত্তোলন ছিল স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের প্রশ্নে চরম মাত্রার বিস্ফোরণ।  পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক নাগপাশ ছিন্ন করে পাকিস্তানি আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরুদ্ধতার চূড়ান্ত রূপ পায়।
জাতীয় পতাকা হচ্ছে সার্বভৌমত্বের প্রতীক।  ২রা মার্চ পতাকা উত্তোলন ছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক মৃত্যুপরোয়ানা।  পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ‘অধীন’ এবং ‘অধীনস্থতার’ জোয়াল চূড়ান্তভাবে ছুড়ে ফেলে নতুন আখ্যান নির্মাণে জনগণ শামিল হতে শুরু করেছিল।
পতাকা উত্তোলন কার্যত সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের চেতনাসমৃদ্ধ করে একটি পরাধীন চেতনার মূলে ফাটল ধরিয়ে দেয়।  মানুষের মনে এ ধারণার জন্ম দেয় যে, পতাকা হচ্ছে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক সত্তা।  বাঙালির স্বপ্নপূরণের বয়ান হচ্ছে এই পতাকা।
২রা মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে ঐতিহাসিক দিন।  এদিন বাঙালি জাতি তার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের পতাকা উড়তে দেখলো জমিনের উপরে। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নির্দেশে ১লা মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।  এই সময় সিদ্ধান্ত হয় ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-গণসমাবেশ অনুষ্ঠানের আর এই ছাত্র গণসমাবেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিউক্লিয়াস।  এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্বাধীনতা উন্মুখ বাঙালি জাতির পক্ষে আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।  এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নূরে আলম সিদ্দিকী।  পতাকা উত্তোলন করার সময় পাশেই ছিলেন শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন সহ ছাত্রলীগের অন্য নেতৃবৃন্দ।
সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে এবং অনুমোদনে আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ, মার্শাল মনি, হাসানুল হক ইনু বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করেন।  বাংলাদেশের পতাকার পরিকল্পনা হয় ১৯৭০ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হলের ১১৬ নং কক্ষে, যা ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ উত্তোলিত হয়।  বাংলাদেশ নির্মাণে বহু গোপন সশস্ত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড ছিল কিন্তু কারো কোনো পতাকার প্রস্তাবনা ছিল না।  বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকার পরিকল্পনায়, উত্তোলনে, নির্মাণে সব কিছুতেই নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ জড়িত ছিলেন।
পতাকা উত্তোলন বাঙালির অজয় শক্তির অবিনাশী ভাস্কর্য, পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রয়োজনীয় স্ফুলিঙ্গ।  পতাকা উত্তোলন করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল।  তখন শুধু একটি পথই খোলা ছিল স্বাধীনতা।
নেতাজির গায়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পোশাক, বীরোদীপ্ত চেহারা এবং তার সেই ডাক- ‘চলো দিল্লি’ বা ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও- আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ এই ছবিটাই বাঙালির মনে আজও প্রকট হয়ে রয়েছে।  অন্য দিকে সূর্যের তীব্র আলোয় লক্ষ ছাত্র-জনতার সমাবেশে গাঢ় সবুজের মাঝে লাল বৃত্তে মানচিত্র খচিত পতাকা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে আছে।
বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজি শুধু পুরোগামী নেতাই ছিলেন না তিনি স্বাধীনতার জন্য জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছেন।  নেতাজির অনন্যসাধারণ ভূমিকা সমগ্র ভারতবাসী অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করছে।  নেতাজির জন্মদিনকে বিজেপি সরকার ‘পরাক্রম’ দিবস হিসেবে পালন করছে।
’৫২-এর প্রেরণার পর ২রা মার্চ পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ ইশতেহার পাঠ, ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র জাতিকে সংগ্রামী ও বিপ্লবী আগুনে পুড়িয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পৌঁছে দেয়-জাতির মাঝে রাষ্ট্রের অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়-জাতির অন্তরে বিপুল শক্তির জন্ম হয়।
আ স ম আবদুর রব একটি জাতি রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে মুক্তিপাগল মানুষের পক্ষে পতাকা উত্তোলন করেছেন ২রা মার্চ দিনদুপুরে লক্ষ জনতার সামনে, যে ছবি দৃশ্যমান।  অথচ এ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন নিয়ে সরকার বা কারো কারো নীরবতা লক্ষণীয়।  নীরবতার প্রশ্নে শুধু এটুকু বলা যায়- যারা সত্যকে স্বীকার করে না তারা দাসতুল্য, ক্ষমার অযোগ্য।
আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে যে দুজন বাঙালি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, বাংলার পলিমাটিতে যাদের জন্ম।  যারা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে ইতিহাস পুনঃনির্মাণ করেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: গীতিকার (faraizees@gmail.com)

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ