বর্ষপঞ্জির সঙ্গে ফিরে আসে যেসব উৎসব

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
বৈশাখের প্রথম দিন আজ। এটি বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ধারক ও বাহক পহেলা বৈশাখ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন এবং সর্ববৃহৎ উৎসব।
অতীতের ভুল ত্রুটি, ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় নববর্ষ উদযাপিত হয়। ক‌রোনাকালে এ উৎসব পালিত হচ্ছে সী‌মিত আকারে। ত‌বে এর আগের বছগেু‌লো‌তে ঐতিহ্য এবং রীতি মেনে সর্বজনীন এবং অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
কয়েকটি অনুষ্ঠানের কথা থাকছে এই আয়োজনে-
বলিখেলা
বলিখেলা চট্রগ্রামের একটি লোকক্রীড়া। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই লোকক্রীড়াটি কবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে অনেকেই মনে করেন, মুঘল আমলে এ খেলা শুরু হয়েছিল এবং মুসলিম আমলেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে অঞ্চলিক যেসব অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় চট্রগ্রামের বলিখেলা তার মধ্যে অন্যতম। তবে এ বছর বলিখেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
পুণ্যাহ
পুণ্যাহ বাংলার রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত বার্ষিক বন্দোবস্তের একটি উৎসব। জমিদারি ব্যবস্থার সঙ্গে পুণ্যাহ উৎসবেরও বিলুপ্তি ঘটেছে। এটি মূলত রাজস্ব বন্দোবস্ত ও আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে একটি মুগল যুগের ব্যবস্থা ছিল। ঐতিহাসিকভাবে, সদর এবং মফস্বল দুই ধরনের পুণ্যাহ প্রচলিত ছিল। সদর কিংবা কেন্দ্রীয় পুণ্যাহ এমন একটি উৎসব যেখানে জমিদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীগণ বাংলার দেওয়ানের বাসভবনে অংশগ্রহণ করতেন। মফস্বল পুণ্যাহ উৎসব জমিদারের কাচারিতে অনুষ্ঠিত হতো। সর্বপোরি পুণ্যাহ একটি কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান ছিল।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান
রাজধানী ঢাকায় বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন করা হয়। ঢাকায় বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা এক মহামিলন মেলা সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা বটমূলে এবং এর চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয়। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’- গানের মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়।
১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) ছায়ানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সংস্কৃতি অঙ্গনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয় এবং বর্তমানে বাংলা নববর্ষ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
নৌকা বাইচ
নৌকার দাঁড় টানার কসরত ও নৌকা চালনার কৌশল দ্বারা জয়লাভের উদ্দেশ্যে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা বাইচ প্রচলিত আছে আবহমান কাল থেকেই। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় নদ-নদীর উপস্থিতি প্রবল।
নৌকা বাইচ এদেশের লোকালয় ও সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ফসল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ পালন উপলক্ষে নৌকা বাইচ আয়োজন করা হয়।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ১৯৮৯ সাল থাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়মিত আয়োজন করে আসছে। তবে যশোরের ‘চারুপীঠ’ নামের একটি সংগঠন ১৯৮৫ সালে প্রথম বাংলা নববর্ষ বরণ করতে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। বাংলা নববর্ষে সব শ্রেণির জনগণের একত্র করার লক্ষ্যেই এই শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু হয়। ১৯৯৫ সালের পর থেকেই আনন্দ শোভাযাত্রাই মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে পরিচিত হয়। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
উপজাতিদের বৈসাবি
বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে আদিবাসীরা পালন করে বৈসাবি উৎসব। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলায় উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসব এটি। বৈসাবি হলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব।
এ উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই এবং ত্রিপুরারা বৈসুক বলে থাকলেও সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলে তা বৈসাবি নামেই পরিচিত। মূলত বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু এই নামগুলির আদ্যক্ষর নিয়ে বৈসাবি শব্দের উৎপত্তি।
হালখাতা
বৈশাখ বরণ বা নববর্ষকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্যগত উৎসব হালখাতা। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির ঐতিহ্যগত এই উৎসবটি। পহেলা বৈশাখে গ্রামবাংলা, শহরে, ছোট-মাঝারি-বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন করা হয়। নতুন বছরের শুরুতে পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার আনুষ্ঠানিকতা হলো হালখাতা। সাধারণত হালখাতায় ব্যবসায়ীরা নিয়মিত ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়ন করে এবং ক্রেতারা পুরাতন বকেয়া পরিশোধ করে দেয়।
গম্ভীরা গানের অনুষ্ঠান
গম্ভীরা গান মূলত একটি আঞ্চলিক অনুষ্ঠান। বাংলা নববর্ষে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় জনপ্রিয় গম্ভীরা গান এবং নৃত্যের আয়োজন করা হয়। লোকগীতি এবং লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান গম্ভীরা। রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে পহেলা বৈশাখ থেকে সারা বছরের জন্য গম্ভীরা অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
এগুলো ছাড়াও বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক পুরানো উৎসব আছে। এগুলোর মধ্যে আন্যতম ঢাকার ঘুড়ি ওড়ানো, মুন্সিগঞ্জের গরুর দৌড়, ঘোড় দৌড়, ষাড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পায়রা ওড়ানো, বহুরূপীর সাজ ইত্যাদি গ্রামবাংলার জনপ্রিয় খেলা। এখন পুরো দেশ করোনাভাইরাস আতঙ্কে রয়েছে। তাই জনসমাগম এড়িয়ে চলে সবাই সুস্থ থাকতে ঘরেই পালন করছে পহেলা বৈশাখ। এবার আর কোনো উৎসবেই একত্র হতে পারেনি বাঙালিরা।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ