প্রতি লিটার বোতলজাত পানিতে গড়ে আড়াই লাখ প্লাস্টিক কণা : গবেষণা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
স্বাস্থ্যসচেতন অনেকে ট্যাপের পানি সাধারণত এড়িয়ে চলেন। তাঁরা পান করেন বোতলজাত পানি বা মিনারেল ওয়াটার। বোতলজাত পানি পানে হয়তো জীবাণুদূষণের মতো ঝুঁকি এড়ানো যায়, কিন্তু এতে আরেকটি স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে যা দীর্ঘমেয়াদে আরও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বোতলজাত এক লিটার পানিতে গড়ে ২ লাখ ৪০ লিটার প্লাস্টিক কণা থাকে। গবেষকেরা বলছেন, প্লাস্টিকের অনেক কণাই আগে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। প্লাস্টিক দূষণের সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য উদ্বেগগুলো নাটকীয়ভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এ গবেষণা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটি গতকাল সোমবার প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণায় প্রথম বোতলজাত পানিতে ন্যানো প্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়েছে। ন্যানো প্লাস্টিক কণাগুলো দৈর্ঘ্যে এক মাইক্রোমিটারের চেয়ে কম, যা মানুষের চুলের প্রস্থের সত্তর ভাগের এক ভাগের সমান।
গবেষণা অনুসারে, বোতলজাত পানিতে পূর্বের অনুমানের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি প্লাস্টিকের কণা থাকতে পারে, কারণ আগের গবেষণায় শুধু মাইক্রোপ্লাস্টিক বা ১ থেকে ৫ হাজার মাইক্রোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট প্লাস্টিক কণা নিয়ে কাজ করা হয়েছে।
মানব স্বাস্থ্যের জন্য মাইক্রোপ্লাস্টিকের চেয়ে ন্যানো প্লাস্টিক বেশি ক্ষতিকর। কারণ ন্যানো প্লাস্টিক মানব কোষের ভেতর প্রবেশ করতে পারে, রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে এবং এতে শরীরের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গে প্রভাব ফেলতে পারে। ন্যানো প্লাস্টিক গর্ভের শিশুর শরীরেও প্রবেশ করতে পারে। বোতলজাত পানিতে ন্যানো প্লাস্টিকের উপস্থিতির বিষয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল ধরেই সন্দেহ করে আসছেন। কিন্তু পৃথক ভাবে ন্যানো কণা শনাক্ত করার প্রযুক্তির অভাবে তা প্রমাণ করতে পারেননি।
এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে, গবেষকেরা একটি নতুন আণুবীক্ষণিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাঁরা একটি ডেটা–চালিত অ্যালগরিদম প্রোগ্রাম করেন এবং এ দুটি উপায় ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড থেকে প্রায় ২৫টি এক লিটার বোতলজাত পানি বিশ্লেষণ করেন। প্রত্যেক বোতলে গবেষকেরা ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পান। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল ন্যানো প্লাস্টিক।
গবেষণার প্রধান লেখক ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষার্থী নাইজিন কিয়ান বলেন, ‘এ গবেষণাটি ন্যানো প্লাস্টিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে শক্তিশালী টুল হিসেবে কাজ করবে। এ গবেষণাটি ন্যানো পর্যায়ে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে জ্ঞানের ঘাটতি দূর করতে সাহায্য করবে’।
গবেষণা প্রতিবেদনটির সহ–লেখক ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রসায়নবিদ বেইঝান ইয়ান বলেন, ‘আগে এ বিষয়ে কোনো তথ্যই ছিল না। বিষক্রিয়া নিয়ে গবেষণায় কেবল অনুমানই করা হতো যে পদার্থে কী কী থাকতে পারে। এ গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের এমন এক দুয়ার খুলে যাবে যা আগে আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়নি’।
গবেষকেরা সাত ধরনের প্লাস্টিক বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে—পলিইথিলিন টেরেফথ্যালেট (পিইটি), যা দিয়ে বেশির ভাগ পানির বোতল তৈরি করা হয় এবং পলিঅ্যামাইড, যা দিয়ে বোতলজাত করার আগে পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টারে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বিজ্ঞানীরা পানিতে অনেকগুলো ন্যানো কণা আবিষ্কার করেছেন যা আগে জানা ছিল না। এগুলোও যদি ন্যানো প্লাস্টিক হয় তবে বোতলজাত পানিতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি আরও অনেক বেশি বলে প্রমাণিত হবে।
বিশ্বে প্রতি বছর ৪৫ কোটি টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়, এর বেশির ভাগই ময়লার ভাগাড়ে যায়। প্লাস্টিকের বড় একটি অংশই প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। তবে সময়ের সঙ্গে এ প্লাস্টিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। সিনথেটিক কাপড়সহ প্লাস্টিকযুক্ত বিভিন্ন পণ্য ব্যবহারের সময়ও ছোট ছোট প্লাস্টিক কণা ঝরতে থাকে।
পৃথিবীর সব অংশেই প্লাস্টিক দূষণ হলেও বোতলজাত পানি নিয়ে বিজ্ঞানীদের বিশেষ আগ্রহের কারণ হলো, এর মাধ্যমে মানব শরীরে প্লাস্টিক কণা প্রবেশ করতে পারে। ২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ট্যাপের পানির চেয়ে বোতলজাত পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব বেশি। ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, বোতলের প্লাস্টিক ক্যাপ শুধু খোলা ও বন্ধ করার মাধ্যমেই পানিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা মিশে যেতে পারে।
সর্বশেষ এ গবেষণার সহ–লেখকেরা বলছেন, তাঁরা বোতলজাত পানি নিয়ে তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যাবেন। ট্যাপের পানিতেও ন্যানো প্লাস্টিকের উপস্থিতি এবং অ্যান্টার্কটিকার বরফের নমুনা নিয়ে গবেষণা করার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব–পদার্থবিদ ও গবেষণার সহ–লেখক ওয়েই মিন বলেন, ‘গবেষণা করার জন্য ন্যানো প্লাস্টিকের বিশাল এক জগৎ রয়েছে। পদার্থ যত ক্ষুদ্র হয় তা তত সহজে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে’।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ