সুস্থ হয়ে পুনরায় আক্রান্ত হচ্ছে করোনায়, আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
চলমান বিশ্ব মহামারি করোনা ভাইরাস নিয়ে চলছে নানাবিধ গবেষণা। কেউ বলছেন এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে, কে বলছেন সময় লাগবে, আবার কেউ বলছেন এটি প্রতি মুহুর্তে তার রূপ পরিবর্তন করায় ঔষধ আবিষ্কার কঠিন হয়ে পড়ছে। এবার সেই ধারায় নতুন একটি ভয়ানক তথ্য তুলে ধরেছে কোরিয়া সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (কেসিডিসি)। তাদের তথ্যানুসারে, সেরে ওঠার পরও পরীক্ষায় দেখা গেছে করোনাভাইরাস ‘পজেটিভ’ পাওয়া যাচ্ছে। সংস্থাটি দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬৩ জন কোভিড-১৯ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর পুনরায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন তাদের ‘পজিটিভ’ এসেছে। সংস্থাটির চিকিৎসকরা এই রহস্য সমাধানে এখন ব্যস্ত। একই ঘটনা ঘটছে চীনেও, তবে নির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া যায়নি। ফলে প্রশ্ন জাগছে, সুস্থ হওয়ার পরও কি আবার ওই মানুষটি সংক্রমণের শিকার হতে পারেন?
কেসিডিসি’র তথ্য মতে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘কোভিড-১৯’য়ে আক্রান্তের পর সুস্থ হয়েছেন ৭ হাজার ৮২৯ জন, যাদের মধ্যে পুনরায় সংক্রমণ দেখা দিয়েছে মাত্র ২.১ শতাংশের মাঝে। যদিও যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের মধ্যে ঠিক কতজনের পুনরায় পরীক্ষা করা হয়েছে সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
তবে সুস্থ হওয়া মানুষের আবার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা পুরো পৃথিবীর মানুষের জন্যই আতঙ্কের সংবাদ। আর দক্ষিণ কোরিয়া এমন একটি দেশ যার নীতি-নির্ধারকরা এই মহামারি পরিস্থিতিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন।
কেসিডিসি’র উপ-পরিচালক কুয়োন জুন-উক বলেন, ‘পুনরায় আক্রান্ত হওয়া রোগীদের ৪৪ শতাংশের মধ্যেই মৃদু মাত্রায় উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। তবে তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ হতে পারে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। ভাইরাসটি সম্পর্কে এখনও অনেক কিছুই অজানা, এমনকি জৈবিকভাবে চিরস্থায়ী আরোগ্যলাভ আদৌ সম্ভব কি না। গত কয়েক দশকে যত ‘প্যাথোজেন’য়ের মুখোমুখি আমরা হয়েছি তার মধ্যে এই করোনাভাইরাসকে জটিল বলা সম্ভব’।
ভাইরাসের ধ্বংসাবশেষ ধরা পড়ছে : স্স্থু রোগীদের আবারও পরীক্ষার ফলাফল ‘পজিটিভ’ আসার এখন পর্যন্ত উপযুক্ত ব্যাখ্যা হলো ভাইরাসের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষায় ধরা পড়ছে। একই পরিবারের তিনজন সুস্থ রোগী যাদের পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ এসেছে তাদের নিয়ে গবেষণা চালায় কেসিডিসি।
কুয়ান বলেন, ‘বিজ্ঞানীরা তাদের শরীরে থাকা ভাইরাস ‘ইনকিউবেট’ করার চেষ্টা করে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন। এথেকে বোঝা যায় সেখানে কোনো সক্রিয় ভাইরাস নেই। অন্যান্য অনেক দেশের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য ‘রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেস চেইন রিঅ্যাকশন (আরটি-পিসিআর)’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পরীক্ষায় রোগীর শরীর থেকে নমুনা নিয়ে তাতে করোনাভাইরাসের জীনগত বৈশিষ্ট্য অথবা ‘আরএনএ’ খুঁজে বের করা হয়।
কুয়ান বলেন, ‘এই পরীক্ষাগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই রোগী সুস্থ হওয়ার পরও শরীরের থেকে যাওয়া ভাইরাসের ‘আরএনএ’ হয়তো ধরা পড়ছে পরীক্ষায়, ফলে ফলাফল ‘পজিটিভ’ আসছে। এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল’।
চীনের অন্যতম ফুসফুস ও শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত অন্ত্র বিশেষজ্ঞ ঝং নানশান এই ব্যাখ্যাকে সমর্থন দেন এবং বলেন, ‘আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নই’।
বিকল্প ব্যাখ্যা গবেষকেরা : অন্যান্য ব্যাখ্যার মধ্যে আছে পরীক্ষায় হয়তো ভুল হচ্ছে কিংবা ভাইরাস পুনরায় সক্রিয় হচ্ছে। পরীক্ষায় ভুল থাকলে ‘নেগেটিভ’ ও ‘পজিটিভ’ দুই ফলাফলেই ভুল হবে। এমনটা হওয়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে। পরীক্ষায় যে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে সমস্যা থাকতে পারে। কিংবা ভাইরাসের এমন ‘মিউটেশন’ হচ্ছে যে পরীক্ষায় তা ধরা পড়ছে না।
কুয়ান বলেন, ‘পরীক্ষায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারপরও যাদের একবার ‘পজিটিভ’ আসছে, বিজ্ঞানীরা একাধিকবার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন যে পরীক্ষায় কোনো ভুল নেই। তবে এবিষয়ে আরও তদন্তমূলক গবেষণা প্রয়োজন’।
পরীক্ষার ফলাফলে ধারাবাহিকতার অভাব রোগীর আতঙ্ক বাড়াবে। জিন কিম নামক একজনকে ২৫ মার্চ পরীক্ষা করা হলে ফলাফল ‘পজিটিভ’ হয়। পরের সপ্তাহে পরীক্ষা করালে ফলাফল ‘নেগেটিভ’ আসে। কিন্তু একদিন পর আবার পরীক্ষা করলে আবার ‘পজিটিভ’ আসে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে আরও দু’বার পরীক্ষা করাতে হবে। কারণ সুস্থতা নিশ্চিত হতে পর পর দু’বার ‘নেগেটিভ’ আসতে হবে।
সুস্থ হওয়ার পরও ‘পজিটিভ’ আসা ব্যক্তি কি ভাইরাস ছড়ায়? : এই বিষয়ে কুয়ান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এমনটা হওয়ার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। তাই আমরা মনে করছি সুস্থ হওয়ার পর ওই ব্যক্তির মাধ্যমে কারও মধ্যে ভাইরাস ছড়াবে না’।
একই বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও চিন্তিত। দেশটির ‘হোয়াইট হাউস করোনাভাইরাস রেসপন্স কো-অর্ডিনেটর’ ডা. ডেবরা বির্ক্স বলেন, ‘একজন সুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে সংক্রামক ‘আরএনএ স্ট্যান্ড’ ছড়িয়ে পড়া সম্ভব কি-না তা এখনও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। করোনাভাইরাস ‘কালচার’ করা এবং এই সম্ভাবনা কতটুকু সে ব্যাপারে বিস্তর গবেষণা চললেও, কোনো গবেষণাতেই চূড়ান্ত ফলাফল মেলেনি’।
এমতাবস্থায় সুস্থ রোগীদের আরও দুই সপ্তাহ ‘সেল্ফ-আইসোলেশন’য়ে থাকার নির্দেশ দিচ্ছে কেসিডিসি।
মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি : একজন মানুষ কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলে তার শরীরে ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি হয়। এটি ভবিষ্যতে ওই ভাইরাসে আবার আক্রান্ত হওয়া থেকে শরীরকে রক্ষা করে, কারণ ‘অ্যান্টিবডি’ জানে কিভাবে সেই ভাইরাসকে রুখতে হবে। তো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টিবডি’য়ের প্রভাব কি? সেটা নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে।
এবিষয়ে বির্ক্স বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে স্স্থু হওয়া রোগীদের মাঝে ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি হতে দেখেছি আমরা, তবে ‘আউটলিয়ারস’ বা কারও মাঝে ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি না হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই থেকে যায়। এই ‘আউটলিয়ারস’ সবসময়ই থাকবে। তবে সেখানে যে ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি হবেই না এমন প্রমাণ আমরা এখনও পাইনি’।
সুস্থ হওয়া রোগীদের শরীর থেকে ৪০০ নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করার পরিকল্পনা করছে কেসিডিসি, দেখার জন্য যে ‘কোভিড-১৯’য়ে একবার আক্রান্ত হওয়া মানুষকে কতটুকু ‘ইমিউনিটি’ বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা দিতে সক্ষম।
কুয়ান বলেন, ‘এই গবেষণার ফলাফল পেতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। তাই সব কথার এখন পর্যন্ত আসল কথা হলো কোভিড-১৯ সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি না’।

ডিসি/এসআইকে/এসএজে