ত্রাণ পাননি ৬৯ ভাগ মানুষ : ব্র্যাক

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
শতকরা ৬৯ ভাগ উত্তরদাতাই বলেছেন তারা ত্রাণ পাননি।  নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে কোভিড–১৯ এর প্রভাব সবথেকে মারাত্মক।  নিম্ন আয়ের কর্মজীবীদের শতকরা ৯৫ ভাগ বলেছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে তারা যতো টাকা আয় করতেন, সেই তুলনায় গড়ে ৭৬ ভাগ কমে গেছে।  শহুরে শ্রমজীবীদের আবার গ্রামীণ শ্রমজীবীর তুলনায় আয় কমেছে বেশি।  গ্রামে ৭৫ ভাগ শহরে এটা কমেছে ৭৯ ভাগ।  অন্যদিকে সার্বিকভাবে স্বল্প আয়ের মানুষের (দিনমজুরসহ) মধ্যে ৬২ ভাগই কাজ হারিয়েছেন।  এছাড়া করোনা চিকিৎসা নিয়ে উত্তরদাতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি চলমান আছে।  ১১ ভাগ বলেছেন উপসর্গ দেখা দেয়া মাত্রই দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা দরকার।  এবং ৪২ দশমিক ৬ ভাগ অর্থাৎ উত্তরদাতাদের অর্ধেকের বেশি মনে করেন উপসর্গ দেখা দিলে হোম কোয়ারেন্টিন/আইসোলেশন উত্তম বিকল্প।  এছাড়া ২৬ শতাংশ মনে করেন করোনার কোনো চিকিৎসা নেই।  ৭৮ ভাগই অবশ্য মনে করেন তাদের করোনা হওয়ার কোনো চান্স নেই।
গতকাল মঙ্গলবার (৯ জুন) ঢাকায় এক জুম সম্মেলনে প্রকাশিত ব্র্যাকের র‌্যাপিড পারসেপশন সার্ভে বা তাৎক্ষণিক ধারণা জরিপে ওই চিত্রই ফুটে উঠেছে।  ব্র্যাক স্টাফরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও পেশার ২ হাজার ৩১৭ ব্যক্তির ওপর জরিপ চালান।  শতকরা ৭৯ ভাগের সঙ্গে ফোনে এবং ২১ ভাগের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনা করে সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণে ডাটাশিট তৈরি করা হয়েছে।
শুধু করোনার কারণেই প্রায় ২৮ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, এই রোগ তাদেরকে আর্থিকভাবে নিষ্ক্রিয় করেছে।  এছাড়া ৫১ ভাগ বলেছেন, করোনায় তাদের পরিবারের আয় শূণ্যে নেমেছে।  ব্র্যাক রিপোর্টে এই তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, প্রায় ২৩ ভাগ মানুষের মধ্যে যারা চাকরি করেন, তারা বেতন পান না।  কিংবা যাদের হাতে শস্যদানা আছে, তারা বিক্রি করতে পারেন না।
তবে ব্র্যাক রিপোর্টে বলা হয়, অতিমহামারি মোকাবেলায় সরকারের নেয়া পদক্ষেপকে অপ্রতুল বলছেন মাত্র ৩০ ভাগ, ৬৩ ভাগই বলেছেন, এটা পর্যাপ্ত।  পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি মানুষ লক্ষণীয়ভাবে সন্তোষজনক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।  ৯১ ভাগের বেশি উত্তরদাতাই ভালো বা খুব ভালো বলে প্রশংসা করেছেন।
কিন্তু যখন তাদের কাছে ত্রাণ বন্টন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে, তখন তাতে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি ছিল লক্ষণীয়ভাবে নেতিবাচক।  কারণ ৩৮ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন, সরকারের সহায়তা এ পর্যন্ত যা মিলেছে, তা অপ্রতুল।  এমনকি শতকরা ৪১ ভাগ বলেছেন ত্রাণ কাদের দেয়া হবে, তার টার্গেট যেভাবে স্থির করা হয়েছে, তাতে ভুল হতে পারে।  শতকরা মাত্র ১৪ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা সরকারি ত্রাণ পেয়েছেন কিন্তু ৬৯ ভাগই বলেছেন, তারা কোন ত্রাণ পাননি।
ত্রাণ না পাওয়ার হার শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি।  গ্রামের ৭২ ভাগ উত্তরদাতা এবং শহরের ৬২ ভাগ বলেছেন তারা ত্রাণ পাননি।  উত্তরদাতারা আরো বলেছেন- যদি এই করোনা সংকট অব্যাহত থাকে দীর্ঘমেয়াদে, তাহলে এটা খুবই সম্ভাবনা যে, তাদের ১৯ ভাগ জীবনযাপনের খরচ সাত দিনের বেশি নির্বাহ করতে পারবেন না। এরমধ্যে ১৭ ভাগ গ্রামের এবং ২১ ভাগ শহর এলাকার।  ২৬ ভাগ মানুষের কোনো পরিকল্পনা নেই যে, তারা কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন।
অবশ্য এক-চতুর্থাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা যে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন সেটা থেকে বাঁচতে হলে তাদেরকে সঞ্চয় তুলতে হবে অথবা সম্পদ বিক্রি করতে হবে।  তবে সামগ্রিকভাবে শতকরা ১৯ ভাগ উত্তরদাতা আশা প্রকাশ করেছে যে, সরকার কিংবা অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান সংকট দীর্ঘতর হলে তারা সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়াবে।
ব্র্যাক রিপোর্টে আরও বলা হয়, ৬৬ ভাগ উত্তরদাতা আশা প্রকাশ করেছেন যে, প্রয়োজনের সময় সরকার তাদেরকে খাদ্য সহায়তা দেবে।  রিপোর্টে বলা হয় উত্তরদাতারা নগদ অর্থ বিতরণ, লকডাউন সম্প্রসারণ এবং প্রতি জেলায় টেস্ট এবং তার চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে বলেছেন।
নারীরা বেশি ক্ষতগ্রস্ত
রিপোর্টে আরও বলা হয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তার একটা লিঙ্গভিত্তিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।  কারণ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, পুরুষের নেতৃত্বাধীন পরিবারের থেকে নারীর নেতৃত্বাধীন পরিবারের আয় বেশি মাত্রায় কমেছে ।  এটা পুরুষের ক্ষেত্রে ৭৫ ভাগ এবং নারীর ক্ষেত্রে ৮০ ভাগ কমেছে।  এরমধ্যে দেখা গেছে, আয় কমার ক্ষেত্রে নারীরা যেসব পরিবারের প্রধান তাদের আয় শূন্যের কোঠায় নেমেছে।  নারী প্রধান পরিবারের আয় ৫৭ ভাগ আর পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৯ ভাগ আয় শূণ্য হয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে এটাও দেখা যায় যে, গ্রামের নারীরা শহরের নারীদের চেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছেন ।  এবং এই তথ্যচিত্রটি এর আগের যে পরিসংখ্যান, তার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।  দেখা যাচ্ছে যে, নারী প্রধান পরিবার পুরুষ প্রধান পরিবারের থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি দরিদ্র।  তাই এতে কোনো বিস্ময় নেই যে, যেখানে পুরুষের থেকে নারীর ত্রাণ দরকার বেশি।  যেখানে নারী প্রধান পরিবার, সেখানে ত্রাণ দরকার ৯০ ভাগ।  পুরুষের দরকার সে তুলনায় ৭১ ভাগ।
কিন্তু রিাপোর্ট বলেছে, দুর্ভাগ্যবশত, ত্রাণ বঞ্চনার ক্ষেত্রে নারীরাই বেশি এগিয়ে।  শতকরা ৭২ শতাংশ নারী সরকার থেকে কোন সাহায্য পায়নি।  কিন্তু পুরুষরা পায়নি শতকরা ৬২ ভাগ।  শতকরা ২১ ভাগ নারী প্রধান পরিবার এক সপ্তাহের বেশি তাদের জীবন যাপনের ব্যয় ভার বহন করতে পারবে না।  এই হার অবশ্য পুরুষের ক্ষেত্রে ৩ ভাগ কম।
একইভাবে ৩০ দিনের বেশি খাবার মজুদ রয়েছে, এমন পরিবারের মধ্যে থেকেও দেখা গেছে নারীপ্রধান পরিবার থেকে পুরুষপ্রধান পরিবারই এক্ষেত্রে এগিয়ে।  এক্ষেত্রে নারীদের হার যেখানে ১৯ দশমিক ৭৬ ভাগ, সেখানে পুরুষের হার হচ্ছে ২২ দশমিক শূণ্য ৭ ভাগ।  নারী প্রধান পরিবার পুরুষ প্রধান পরিবারের চেয়ে অনেক বেশি আর্থিক অনিশ্চয়তায় আছে।  ৩০ ভাগ নারী প্রধান পরিবার জানে না ভবিষ্যতে তারা কিভাবে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে।  এই অবস্থাটা পুরুষদের শতকরা ২৫ ভাগ মনে করেন ।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েছে
উন্নত দেশগুলোতেও এরকমই চিত্র পাওয়া গেছে।  ব্র্যাক জরিপেও সেটা ফুটে উঠেছে।  করোনাকালে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে বাংলাদেশেও।  এর আগেও একাধিক করোনাকালের সমীক্ষায় একই চিত্র ফুটে উঠেছে।  ব্র্যাক রিপোর্ট বলেছে এই সময়ে প্রায় ১১ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন যে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়ে গেছে।  তবে ব্র্যাক রিপোর্ট একটা কৌতূহল উদ্দীপক তথ্যও দিয়েছে।  ১০ ভাগ নারীর তুলনায় শতকরা ১২ ভাগ পুরুষ বলেছেন, তারাও তাদের পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।  একইভাবে গ্রামের তুলনায় শহরে নির্যাতনের হার বেশি।  প্রায় সাড়ে ১৩ ভাগ শহরে আর ৯.৬৫ ভাগ গ্রামের উত্তরদাতা সহিংসতার অভিযোগ করেছেন।  অবশ্য শতকরা ৫৮ ভাগই বলেছেন যে, নারীর বিরুদ্ধে এই সহিংসতার মূলে রয়েছে করোনাকালে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ