বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
৭০ লক্ষ মানুষের এই চট্টগ্রাম মহানগরে করোনা ভাইরাস শনাক্তে নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা মাত্র ৬৫০ জনের! শুনতে খটকা লাগলেও বাস্তবতা সত্য। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। তবে, যে ৬৫০ জনের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতার কথা বলা হচ্ছে তারও সব চট্টগ্রামবাসী পাচ্ছে না। এই ৬৫০ জনের মধ্যে রয়েছেন রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার অন্যান্য উপজেলাগুলোও। ৬৫০ জনের বিপরীতে প্রতিদিন নমুনা সংগৃহিত হচ্ছে হাজারের উপরে। ফলে প্রতিদিনই জমে যাচ্ছে নমুনা। এতে করে এর ফলাফল নির্ণয় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সাধারণত নমুনা সংগ্রহের সময় থেকে এর কার্যকারিতা থাকে প্রায় ১ সপ্তাহ। কিন্তু প্রতিদিনই নমুনা জটের কারণে অধিকাংশ নমুনাই নষ্ট হচ্ছে বলে ল্যাবসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এরমধ্যে আবার নমুনা সংগ্রহে যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করার ভুলে নষ্ট হয় অনেক নমুনা। ফলে সাধারণ মানুষ নমুনা দিয়ে প্রতিবেদন প্রত্যাশার পাশাপাশি শঙ্কায় থাকেন রিপোর্ট পজেটিভ হবে নাকি নেগেটিভ। এই শঙ্কার সাথে যুক্ত হয়েছে নমুনার সঠিক প্রতিবেদন পাবেন কিনা- সেই শঙ্কাও।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিআইটিআইডি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ইউনিভার্সিটির (সিভাসু) ল্যাবে মোট ৬৫০ জনের নমুনা পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ল্যাবে শুধুমাত্র চট্টগ্রামের অধিবাসীদের নমুনা নেয়া হলেও বিআইটিআইডিতে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলা ও উপজেলা, সিভাসুতে চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যান্য জেলার অধিবাসীদের নমুনা সংগ্রহ করে। ফলে চট্টগ্রাম নগরের অধিবাসীরা সর্বোচ্চ এক থেকে দুইশতজন প্রতিদিন তাদের নমুনা জমা দিতে পারেন। তারমধ্যে সবার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব যেমন হয় না, তেমনি অনেকের নমুনা নষ্ট হয়ে যায় পদ্ধতিগত ভুলের কারণে। প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের মধ্যে এই নামমাত্র সংখ্যক মানুষ যেখানে করোনার নমুনা দিতে পারছেন সেখানে এর বাইরে থাকা, নমুনা দিতে ব্যর্থ হওয়া মানুষদের মধ্যে কি পরিমাণ করোনায় আক্রান্ত তা থেকে যাচ্ছে হিসেবের বাইরে। এই মারাত্মক সংকটের উপর নমুনা নষ্ট, নমুনা জট, নমুনা দিতে গিয়ে বিরম্বনা, ভুল রিপোর্ট ইত্যাদি কারণে মানুষ এখন আর নমুনা দিতেও সন্দিহান। ফলে করোনার প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা অজানা থাকা ছাড়াও ঘরে ঘরে এটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা মারাত্মকভাবে ভর করেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরবরাহকৃত নমুনা পরীক্ষার কীটে সমস্যা আছে জানিয়ে নমুনা পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি নমুনা পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিকেই ২০০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২০০ জনেরই করোনা পজেটিভ হওয়ার তথ্য জানতে পারে। পরে যাচাই-বাছাই করে দেখা যায় কীটগুলোতেই রয়েছে সমস্যা। এর আরো একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে বি-বাড়িয়া জেলার একটি ঘটনা। সম্প্রতি সেখানকার এক ব্যক্তি তার চাচাসহ মোট ৪ জন নমুনা পরীক্ষা দেয়ার জন্য সরকারি ফরম পূরণ করেন। এর কিছুদিন পর সেই ব্যক্তিকে নমুনা দেয়ার জন্য ফোন করা হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখে ওই ব্যক্তির ব্যক্তিগত জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় তিনি নমুনা পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কয়েকদিন পর তার কাছে ফোন আসে তিনি করোনা পজেটিভ। এছাড়াও তার পরিচিত জনেরাও তার নাম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের তালিকায় দেখতে পেয়ে তাকে জানান। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন- আমি নমুনাই দিলাম না। আমাকে বলা হলো আমি করোনা পজেটিভ!
ইতোমধ্যে করোনা শনাক্তের জন্য সংগৃহীত চট্টগ্রামের ৪ হাজার নমুনাও নষ্টের পথে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবে আড়াই হাজার, আর বিআইটিআইডি ল্যাবে রয়েছে দেড় হাজারের মতো। যেগুলোর পোস্টমর্টেমের জন্য এখন ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ নমুনা এক সপ্তাহ পর্যন্ত ঠিক থাকে। এরপর আস্তে আস্তে সেগুলোর মান কমতে থাকে। যেগুলো থেকে সঠিক ফলাফল নাও আসতে পারে। সে হিসাবে চমেক ও বিআইটিআইডি ল্যাবে জমে থাকা ৪ হাজার নমুনা নিয়ে সপ্তাহ পেরিয়ে মাসও হয়ে গেছে। ফলে এসব নমুনার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রামে করোনা টেস্টের অপ্রতুলতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, সংগৃহীত নমুনার তুলনায় পরীক্ষার সুবিধা চট্টগ্রামে শুরু থেকেই অপ্রতুল ছিল। ফলে পর্যায়ক্রমে দুটি ল্যাবে প্রায় ৪ হাজার নমুনা জটের কবলে পড়ে। এরমধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ল্যাবে প্রায় আড়াই হাজার, আর বিআইটিআইডি ল্যাবে দেড় হাজারের মতো। তিনি বলেন, প্রতিদিন গড়ে ৬০০ থেকে ৬৫০ নমুনা পরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা রয়েছে নগরীর তিনটি ল্যাবে। কিন্তু বিপরীতে প্রতিদিন ১ হাজারেরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে করে জটে পরে সংগৃহিত নমুনাসমূহ।
চমেক হাসপাতালের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. শামীম হাসান নমুনা জট ও করোনা টেস্টের অপ্রতুলতার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, চমেক হাসপাতালে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার নমুনা জমা হয়ে গেছে। এরমধ্যে ২ হাজার নমুনা ঢাকায় পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। তবে এসব নমুনার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বলতে গেলে নমুনাগুলোর পোস্টমর্টেম করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের সক্ষমতা যা আছে তার বাইরেতো আমরা টেস্ট করতে পারি না।
তবে সংকট নিরসনে চট্টগ্রামে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা আরো বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিআইটিআইডির ল্যাব ইনচার্জ ডা. শাকিল আহমেদ। তার অভিমত, বর্তমানে যে সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে, পরীক্ষার সুবিধা অন্তত এর দশগুণ বাড়াতে হবে। বিদ্যমান ল্যাবগুলোতে জনবল দেয়ার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে পিসিআর ল্যাব চালুর সুযোগ আছে, সবখানেই ল্যাব চালুর ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
ডিসি/এসআইকে/আইএস