ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি >>>
দেশে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে। সরকার বারংবার নানাভাবে দেশের মানুষকে সচেতন করছে কিছু নিত্য জীবনাচরণে পরিবর্তন আনতে। এর অন্যতম হচ্ছে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং জনসমাগমের সৃষ্টি হয় এমন যে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করা, মাস্ক ব্যবহার করা ইত্যাদি। রাজধানী ঢাকার পরই এখন চট্টগ্রাম করোনার করাল গ্রাসে জর্জরিত। ইতোমধ্যে সরকারি হিসেবে মৃত্যু ছাড়িয়ে শতের ঘর, আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘুরে ঘুরে সেবা না পেয়ে সড়কে, অ্যাম্বুলেন্সে, ব্যক্তিগত গাড়িতে কিংবা সময় মত প্রয়োজনীয় সেবা না পাওায়ায় ইতোমধ্যে বেশকিছু মৃত্যু চট্টগ্রামবাসীসহ দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করেছে।
এমন পরিস্থিতিতেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শুধুমাত্র মিডিয়ার মাধ্যমে সব সময় প্রচারে থাকার মানসে রীতিমতো জনসমাগম ঘটিয়ে ত্রাণ বিতরণ, বুথ উদ্বোধন, পরিদর্শন করে প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। শুধু তাই নয়, নগরে করোনা পরীক্ষায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম নগরে প্রথমধাপে ৬টি করোনা টেস্ট বুথ স্থাপন কাজে সহযোগিতা দিচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। যদিও বুথ স্থাপনে সিটি কর্পোরেশন শুধু জায়গাটি সিলেকশনে সহযোগিতা করছে, কিন্তু বুথ স্থাপনের পুরো কারিগরি প্রক্রিয়া, এ সংক্রান্ত খরচ- সবগুলোই বহন করছে ব্র্যাক। ইতোমধ্যে গত ৪
জুন সকালে নগরের প্রেস ক্লাব ও উত্তর কাট্টলীতে দুইটি বুথ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। উত্তর কাট্টলীতে যে বুথটি স্থাপন করা হয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ। আর এর আগে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে বুথ উদ্বোধনের সময়ও একই পরিমাণ বা তার কিছু কম/বেশি মানুষ উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবারও (১১ জুন) বেলা ১১ টায় হালিশহরের ছোটপুলস্থ এমএ সালাম নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ বুথের উদ্বোধন করেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এখানেও প্রায় শতাধিক মানুষকে দেখা গেছে। ছিল না কোনো সামাজিক দুরত্বের বালাই। এর আগে নগরের প্রিয়া কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রাম ডেকোরেটার্স মালিক সমিতির আওতাভুক্ত ডেকোরেটর মালিকদের মাঝে প্রধান অতিথি হিসেবে তার পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করেছেন তিনি। এসময় উপস্থিত ছিলেন ডেকোরেটার্স মালিক সমিতির সভাপতি হাজী সাহাব উদ্দিন ও কমিউনিটি সেন্টার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন চৌধুরী দুলাল। সেখানে উপস্থিত ছিলো প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সিটি মেয়রের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খুব কৌশলে হলেও নিজের কর্ম-তৎপরতা তুলে ধরার জন্য বেশ সক্রিয় আ জ ম নাছির উদ্দীন।
সেখানে উপস্থিত এক ডেকোরেটর মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, আমার বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। মেয়র সাহেব তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আমাদের কিছু সাহায্য করবেন বলে ডেকোরেটর মালিক সমিতি থেকে বলা হয়েছে। সে জন্য প্রিয়া কমিউনিটি সেন্টারে (মোমিন রোড) আসতে বলবো। আমি আসতে চাইছিলাম না। কারণ সেখানে অনেক মানুষ থাকবে। মেয়র থাকা মানে অনেক মানুষের জটলা। যদি কারো করোনা থাকে, আর সেটা আমাকেও পায়.. তাহলেতো আমি নিশ্চিত মরবো। কারণ চিকিৎসাতো পাওয়া যাচ্ছে না। সমিতিকে বলেও কোনো কাজ হয়নি। সংগঠন করি বলে আসতে বাধ্য হলাম।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হালিশহর এলাকার এক ডেকোরেটর ব্যবসায়ী দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, আমি বলেছিলাম ত্রাণগুলো সমিতি গ্রহণ করুক। আমরা আস্তে আস্তে সুবিধামতো গিয়ে সেগুলো নিয়ে আসবো। এতে করে অন্তত মানুষের জটলায় গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু মালিক সমিতির কড়া নির্দেশনা ছিল। তাদের কথায় বোঝা যাচ্ছিল অনুষ্ঠান করেই এসব ত্রাণ দেয়ার পক্ষপাতি সংশ্লিষ্টরা।
একটি এনজিও সংস্থায় কাজ করেন জাহেদা সুলতানা (ছদ্মনাম)। তার কাজও স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত। তিনিও মেয়রের একটি বুথ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন। দৈনিক চট্টগ্রামকে তিনি বলেন, আমি আসার পক্ষপাতি ছিলাম না। কারণ এসব জনসমাগমমূলক অনুষ্ঠান থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু বসের কড়া নির্দেশে আসতেই হলো। একটু আলাদা করে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছিলাম না। অন্তত দুইশো মানুষ। কি করবো বলেন, চাকুরি করি…।
ইপিজেডে গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র কর্মকর্তা আসাদুল হাবিব দুলাল দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, বুথ উদ্বোধনের নামে, ত্রাণ বিতরণের নামে তিনি জনসমাগম ঘটিয়ে অনুষ্ঠান করছেন। সেগুলো সংবাদমাধ্যমগুলোতে আসছে। তিনি কিছুদিন আগেও বুথ উদ্বোধন করেছেন। এরকম বুথকি বার বার উদ্বোধনের দরকার আছে? এখনকি এসব করার সময়? চট্টগ্রামের মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মরছে। প্রতিদিন হৃদয়ভাঙা গল্প তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসা না দিয়ে মানুষদের ভোগান্তিতে ফেলছে। একজন মেয়র হিসেবে, নগরবাসীর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেখানে উদ্যোগ না নিয়ে আলাদা আলাদা কাজ নিচ্ছেন। তাও গত তিনমাসে তিনি করোনার সংকট মোকাবেলায় যে উদ্যোগগুলো নিয়েছেন তার সবই অসম্পন্ন। কোনো কাজই তিনি সফলভাবে শেষ করতে পারেননি। নগরবাসিন্দা হিসেবে এটি মেনে নেয়া কষ্টকর। তার ভূমিকা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।
নগর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, এখনতো রাজনীতি করার সময় নেই। সরকারি ত্রাণ আসছে সেগুলো অনুষ্ঠান করে দেয়ার সুযোগ নেই। আমি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে মানুষকে ত্রাণ দেবো সেটা অনুষ্ঠান করে, কিংবা ঘটা করে দেয়ার কিছু নেই। বরং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আমি নিজেই চাইবো সেসব না করতে। কারণ একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেখানে থাকেন, যাবেন, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে জটলা হবেই। এসব ত্রাণ সহায়তা বিতরনের অনেক ভালো পদ্ধতি আছে, সেটি সবাই জানেন। এখন যেহেতু এসব জটলা করার পরিস্থিতি নেই, সে জন্য এসব এড়িয়ে চলাই ভালো। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, সিটি মেয়র যেন তার বিপরীতে হাটছেন। তিনি জনসমাগমমূলক কর্মসূচিতে যাচ্ছেন, ত্রাণ দিচ্ছেন, বক্তব্য দিচ্ছেন যা ঠিক হচ্ছে না। এতে সাধারণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে চলমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকা মূল্যমাণের ব্রান্ড নিউ রেঞ্জ রোভার গাড়ি হাঁকানো নিয়েও সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হন আ জ ম নাছির উদ্দীন। এরও আগে সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার দেড় বছরের মাথায় নিজের কিশোর ছেলেলে প্রায় ২ কোটি টাকা দামের গাড়ি কিনে দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।
ডিসি/এসআইকে/আইএস