মাহমুদ এ রাফি, নগর প্রতিবেদক >>>
চট্টগ্রামের ১০ রেডজোনের প্রথম এলাকা হিসেবে লকডাউন চলছে নগরের ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলীতে। তবে প্রথমদিনে খুবই ঢিলেঢালাভাবে চলেছে লকডাউন। রাত থেকে অবিরামবৃষ্টিও যেন এই লকডাউনকে কঠোর করতে পারছিল না। এর কারণ, বাসিন্দা হিসেবে উত্তর কাট্টলীর মানুষ ঘরে থাকলেও বিভিন্ন শিল্প কারখানা খোলা থাকায় এলাকার এবং এলাকার বাইরে থেকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের যাতায়াত ছিল চোখে পড়ার মতো।
এছাড়াও ওয়ার্ডের বিভিন্ন অলি-গলিতে মানুষের আড্ডা ও দোকানপাট খোলা ছিল প্রতিদিনের মতোই। ওয়ার্ড অফিসে অযাচিত/অপ্রয়োজনে মানুষের জটলা ছিল চোখে পড়ার মতো। ওয়ার্ডে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কগুলোর মুখে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হলেও সেগুলোর ফাঁক দিয়ে মানুষের আসা-যাওয়াও ছিল অবিরত। এমনকি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, রিক্শা যাত্রী নিয়ে চলতে দেখা গেছে। তবে বেলা ১২ টার পর বৃষ্টির বেগ একটু বেড়ে গিয়ে তা একাধারে পড়তে থাকায় মানুষের চলাফেরা কমেছে। মূলত অবিরাম বৃষ্টিই এখানে শুরু হওয়া ঢিলেঢালা লকডাউনকে কঠোর করেছে।
সরেজমিনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওয়ার্ডের আগ্রাপাড়া দিয়ে মজুমদার বাড়ি হয়ে কমিউনিটি সেন্টার, সেখান থেকে চৌধুরীপাড়া হয়ে ছোট ও বড় কালীবাড়ি, মোস্তফা-হাকিম কলেজ রোড, ঈশান মহাজন রোড, আমানত উল্লাহ শাহ পাড়া-আচার্য্য পাড়া, কমিউনিটি সেন্টার মোড় থেকে স্টেডিয়াম সড়ক এবং কমিউনিটি সেন্টার থেকে কর্ণেলহাট মোড় পর্যন্ত প্রতিটি সড়ক-উপসড়কে মানুষের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। কোনো সংবাদ মাধ্যম আসা মানেই ছিল জটলা বাঁধানো, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন সিটি মেয়র, কাউন্সিলর, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আগমনে ছিল মানুষের জটলা।
লকডাউন কার্যকরের সময় আজ বুধবার (১৭ জুন) ভোরগত রাত ১২টা এক মিনিটে ওয়ার্ডে আসেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। উদ্দেশ্য কঠোর লকডাউন পালনে এখানকার অধিবাসীদের ঘরে রাখা, এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বরতদের সাথে কথা বলা। সিটি মেয়রের আগমনকে কেন্দ্র করেও শত মানুষের জটলা দেখা গেছে। এলাকার কাঁচা সবজি বিক্রেতারা তাদের কাছে থেকে যাওয়া সবজি নষ্ট হওয়ার ক্ষতি নিয়ে কাউন্সিলর অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন।
স্থানীয় এক পদবীধারী গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতা দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, মেয়র যখন রাতে আসেন তখন বার বার সেখানে যাওয়ার জন্য ফোন আসছিল। যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও রাজনৈতিক কারণে যেতে হয়েছে। সেখানে জটলা ছিল চোখে পড়ার মতো।
এদিকে, উত্তর কাট্টলীতে লকডাউনে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা খোলা রাখা, মানুষের অবাধে চলাফেরা, সিটি মেয়রসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ঘিরে জনসমাগত- ইত্যাদি বিষয়ে সেখানকার বাসিন্দারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কঠোর ক্ষোভ জানান।
স্থানীয় অধিবাসী ও দৈনিক প্রথম আলো’র ফটো সাংবাদিক জুয়েল শীল কয়েকটি ছবি দিয়ে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, লকডাউনের নামে তামাশা চলছে। কারখানা খোলা রেখে কাট্টলীর মানুষকে ঘরবন্দী করে দিছে। কর্তৃপক্ষের সৃদুষ্টি আশা করছি। তিন মাস মানুষ অনেক কষ্ট করেছে। এখন আবার ২১ দিনের লকডাউন। সুষ্ঠু পরিকল্পিত লকডাউন চায় নগরবাসী।
স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান জনি সকালে ব্যারিকেড ডিঙিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের যাতায়াতের কয়েকটি ছবি পোস্ট করে লিখেন- ‘লকডাউনের ভিতরে সকালে গার্মেন্টস কর্মীরা কাজে যোগদান করে। মালিকদের আইনের আওতায় আনা হোক। কাট্টলীতে অবস্থিত সব গার্মেন্টস বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় এলাকাবাসী বন্ধ করতে বাধ্য হবে’।
স্থানীয় মো. রফিক উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি কয়েকটি ছবি পোস্ট করে লিখেন- ‘লালদীঘির পাড়ে জব্বারের বলি খেলার পরিবর্তে উত্তর কাট্টলী চলতেছে লকডাউন বলিখেলা’।
নিউ মনছুরাবাদ সমাজের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হায়দার আলী এক স্ট্যাটাসে বলেন, বিশ্বকলোনী ও ফিরোজশাহ’র হাজার হাজার লোক মনছুরাবাদ দিয়ে চলাচল করছে। বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হোক’।
তবে অব্যাহত সমালোচনার মুখে দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর টহল দল, স্থানীয় কাউন্সিলর, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত লকডাউন এলাকায় খোলা রাখা বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেসব বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চাপ দেন। পরে সম্মিলিত চাপের মুখে শ্রমিকদের ছুটি দিতে বাধ্য হয় কিছু প্রতিষ্ঠান। ১৮ জুন থেকে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠানই খোলা রাখা যাবেনা বলে নির্দেশনা দেয় প্রশাসন। এরপরই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা শুরু হয়। তাতে এলাকার মানুষ ধন্যবাদ জানায় প্রশাসনকে।
সিএমপির পাহাড়তলী জোনের সহকারী কমিশনার আরিফ হোসেন দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, শুরু থেকেই আমরা কঠোরভাবেই নজরদারি করছি। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান অযাচিতভাবে খুলে রাখায় বাইরে থেকে শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে কাজে আসে। এ জন্য লকডাউন নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন ওঠে। তবে দুপুরের দিকে আমরা সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি। আজকে প্রথম দিনে হয়তো প্রস্তুতিতে একটু সমস্যা হচ্ছে, তবে কালকে থেকে এটি ঠিক হয়ে যাবে। কঠোরভাবেই এখানে লকডাউন নিশ্চিত করা হবে।
স্থানীয় কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, ওয়ার্ডে লকডাউন কার্যকরে যথেষ্ঠ প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে। কেউ যেন ঘর থেকে বের না হন সে জন্য আমরা সবাইকে জানিয়েছি। আমাদের এখানে জরুরি প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রেডজোনে অবস্থিত শিল্প-কারখানাগুলো (সাগরিকা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা ছাড়া) বন্ধ রাখার কথা ছিল। কিন্তু হুট করে কি কারণে এসব শিল্পকারখানা আজকে খুলে দেয়া হলো এটা আমার নলেজে নেই। কারখানা খোলার কারণে বিভিন্ন স্থান থেকে নারী-পুরুষ শ্রমিকেরা অবাধে লকডাউন এলাকায় প্রবেশ-বেরোনোর কারণে কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তবে আমরা এসব শিল্পকারখানা বন্ধের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছি।
ডিসি/এসআইকে/এমএআর