উত্তর কাট্টলীতে লকডাউন : বাহিরে ফিটফাট, ভেতরে বাজার-হাট

ছবিটি শনিবার বেলা সাড়ে ১১ টায় কর্ণেল জোন্স সড়ক থেকে তোলা।

মাহমুদ এ রাফি, নগর প্রতিবেদক >>>
রেডজোন হিসেবে চট্টগ্রামের প্রথম লকডাউন এলাকা উত্তর কাট্টলী।  গত ১৬ জুন (মঙ্গলবার) দিবাগত রাত ১২:০১ মিনিট থেকে এই ওয়ার্ডটিতে লকডাউন কার্যকর করা হয়।  প্রথম দিন ১৭ জুন ঢিলেঢালাভাবে লকডাউন পালন, এলাকায় মানুষের স্বাভাবিক বিচরণ, সড়ক-উপসড়কে আড্ডাবাজি, দোকানপাট খোলা রেখে ভীর সৃষ্টি এবং লকডাউন এলাকায় সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে গার্মেন্টস খোলা রাখায় অবাধে গার্মেন্টস শ্রমিকদের যাওয়া-আসা নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে।  সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে এর প্রতিফলন দেখা যাওয়ার পাশাপাশি দৈনিক চট্টগ্রামসহ সংবাদমাধ্যমগুলোও একই সংবাদ প্রচার করে।  ফলে নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরাও।  প্রথমদিন বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, জরিমানা, দুপুরের দিকে গার্মেন্টসসমূহ বন্ধ রাখতে স্থানীয় কাউন্সিলরসহ সেনাবাহিনী-পুলিশের হস্তক্ষেপে কিছুটা ফাঁকা হয় সড়ক-উপসড়কগুলো।  পরেরদিন ১৮ জুন সকাল থেকেই নিম্ন আয়ের মানুষসহ স্থানীয়রা সড়কে আগের দিনের মতোই নেমে পড়ে।  সেনাবাহিনী-পুলিশসহ স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে চোর-পুলিশ খেলার মধ্যেই শুরু হয় অবিরাম বৃষ্টি।  ঢিলেঢালা সেই লকডাউনকে যেন হঠাৎ করেই কঠোর করে দেয় এই অবিরাম বৃষ্টি।  এরপরের দিন ১৯ জুন শুক্রবার হওয়ায় আগের দু’দিনের জটলা কিছুটা কম দেখা যায়।
কিন্তু আজ শনিবার (২০ জুন) অন্যান্য দিনের মতোই ভেতরের প্রতিটি সড়ক-উপসড়ক, অলিগলিতে মানুষের জটলা দেখা গেছে।  অন্যদিকে সবজি-মাছ ও ফল-ফলাদির ভ্যানগাড়িগুলোকে ঘিরে ছিলো মানুষের জট।  প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষকে সড়কে দেখা গেছে স্বাভাবিকভাবেই।  অধিকাংশেরই নাকে-মুখে ছিল না মাস্ক। কেউ কেউ মাস্ক রাখলেও তা জামীর নীচে নামিয়ে রেখেছেন।  সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশের টহল আসলে গলিতে ঢুকে যাওয়ার মতো চোর-পুলিশ খেলাও লক্ষ্য করা গেছে।  অন্যদিকে নিউ মনছুরাবাদেও ভেতরে মানুষের জটলা দেখা গেছে।  আর অলংকার থেকে সাগরিকা পর্যন্ত উত্তর ‍কাট্টলীর অংশে কোনো ধরণের লকডাউন লক্ষ্য করা যায়নি।
আজ শনিবার (২০ জুন) সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সরেজমিনে ঘরে দেখা গেছে, উত্তর কাট্টলীতে প্রবেশের কর্ণেলহাটের দুটি সড়কমুখে, বাদামতলীর সড়ক মুখে, ধুপপুল সড়ক মুখসহ বেশকিছু সড়কমুখে (প্রবেশদ্বার) মোট ১৭ জন স্বেচ্ছাসেবককে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।  যদিও মোট ২০০ স্বেচ্ছাসেবক রাখার ঘোষণা দিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।  যেসব স্বেচ্ছাসেবককে দায়িত্বপালন করতে দেখা গেছে তাদের কয়েকজনের নাক-মুখ মাস্ক দিয়ে ঢাকা থাকলেও অধিকাংশেরই ছিল না ভাইরাস প্রটেকশনমূলক উপকরণ।  কারো কারো মাস্ক থাকলেও সেটি ছিল মুখের নীচের অংশে।  এছাড়াও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও মাস্ক ছাড়া ও মাস্ক মুখের নীচে জামীতে নামিয়ে রাখতে দেখা গেছে।  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে।
প্রবেশমুখগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রবেশ-বাহিরে কঠোরতা দেখাতে পারলেও অঞ্চলটির পুরো এলাকাজুড়ে দেখা গেছে মানুষের অবাধ চলাচল।  কাঁচা বাজার, মাছ ও ফলমূলের ভ্যানগাড়িগুলোরে চারপাশে দেখা গেছে জটলা।  স্থানীয় অনেককে বলতে দেখা গেছে, ‘বাহিরে ফিটফাট, ভেতরে বাজার-হাট’।  সরেজমিনে ঘুরে তাদের এমন কথার সত্যতাও পেয়েছে প্রতিবেদক।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবু সুফিয়ান দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, প্রশাসন-জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন যাতে এলাকা থেকে কেউ বাহির কিংবা এলাকায় প্রবেশ না করতে পারে।  এছাড়াও মানুষ যাতে অযথা বাইরে চলাচল না করে সেটিও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।  কিন্তু আমরা দেখছি, এখানকার মানুষগুলো সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে চোর-পুলিশ খেলছে।  আমরা যদি সচেতন না হই তাহলেতো লকডাউন কার্যকর হবে না।
স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ইকবাল চৌধুরী অভিযোগ করে জানান, এলাকার কিছু মানুষ অযথা কন্ট্রোল রুমে ফোন দিচ্ছে।  আমরা এমনও প্রমাণ পেয়েছি যে, রাস্তায় হেঁটে হেঁটে মোবাইল করছে তার ৫ কেজি আলু আর মুরগী লাগবে।  আমরা সেগুলো নিয়ে যখন যাই তখন সেই লোককে রাস্তাতেই ঘোরাফেরা করতে দেখি।  জাকের আলী সওদাগর বাড়ির সেই লোক আলু আর মুরগী লাগার যে প্রয়োজনের কথা কন্ট্রোল রুমকে জানিয়েছিল তা ছিল শুধু শুধু।  তাকে আমরা পুলিশে দিতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না।  আমাদের মধ্যে সচেতনতা না থাকলে লকডাউনে কাজ হবে না।  সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আগামিকাল রবিবার থেকে আমরা এলাকাভিত্তিক নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরে ঘরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপহার সামগ্রী, শুকনো খাবার বিতরণ কর্মসূচী শুরু করবো।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের একজন দায়িত্বশীল জানান, লকডাউনের আগে প্রশাসন থেকে যে ধরণের সহায়তা দেয়ার কথা ছিল তা কিন্তু দেয়া হচ্ছে না।  দুইশ স্বেচ্ছাসেবক দেয়ার কথা ছিল।  কিন্তু সম্মানী ছাড়া সারাদিন কি স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করবেন?  প্রতিজনকে ৩০০ টাকা করে দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে।  সে জন্য প্রতিশ্রুতিমতো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।  সকল দায়-দায়িত্ব কাউন্সিলরের উপর এসে পড়ছে।  সুষ্ঠু সমন্বয় করা গেলে সবাই যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে এতো সমস্যা হতো না।  কাউন্সিলরের একারপক্ষে এতো কাজ মনিটরিং করা সম্ভব নয়। কাউন্সিলর কার্যালয়ে উপস্থিত এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, বর্তমান মেয়রের পায়ের নিচে মাটি নেই।  প্রধানমন্ত্রীকে খুশী করতে তিনি হুটহাট দায়িত্ব নিয়ে ফেলেন।  এর প্রমাণ উত্তর কাট্টলীতে।  তিনি সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স দেবেন বলেছিলেন।  এলাকায় এমনও ঘটেছে আমাদের কাছে অ্যাম্বুলেন্স চেয়েও সময়মতো না পেয়ে তারা বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রোগী নিয়ে গেছে।  অথচ এখানে স্ট্যান্ডবাই দু’টি অ্যাম্বুলেন্স থাকার কথা। এখন একটিও নেই।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি।  আমার একার পক্ষেতো লকডাউন কঠোর করা সম্ভব নয়।  এলাকাবাসীকে সহযোগিতা করতে হবে।  চোর-পুলিশ খেলা বন্ধ করতে হবে নিজেদের স্বার্থেই।  আমরা রাত-দিন কাজ করছি।  তিনি সবাইকে সমন্বিতভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি এলাকাটিকে করোনা মুক্ত করতে।

ডিসি/এসআইকে/এমএআর