হঠাৎ কেন ভিআইপিদের চার দিনের কোয়ারেন্টিন!

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
১৫ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাজ্যফেরত যাত্রীদের মাত্র চার দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার আদেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অথচ কদিন আগেও যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের সঙ্গে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকলেও দুই সপ্তাহের বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখার সিদ্ধান্ত ছিল। এতে করে করোনার নতুন ধরনটি দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে হোম কোয়ারেন্টিনের ভুল পদক্ষেপে আজ বাংলাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। ফের ভুল পদক্ষেপ নেওয়া হলে বড় খেসারত দিতে হবে। গত কয়েকদিনে অনেকটা কমে এলেও এতে আবার বেড়ে যেতে পারে সংক্রমণের হার।
হঠাৎ কেন চার দিনের কোয়ারেন্টিন ঘোষণা করলো স্বাস্থ্য অধিদফতর, জানতে চাইলে অধিদফতরের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ভিআইপিদের তদবিরের কারণেই অধিদফতর এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্যফেরতদের মধ্যে ভিআইপির সংখ্যা বেশি। তারা কোনো ভাবেই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে রাজি না। তারা নানান তদবির করেন বেরিয়ে আসার জন্য। তাই ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি পরীক্ষায় পজিটিভ পাওয়া না গেলে তাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদফতর।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন ধরন (ভেরিয়েন্ট) শনাক্ত হওয়ার পর যুক্তরাজ্য থেকে আসা সব যাত্রীদের জন্য কড়াকড়ি আরোপ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকার আশকোনার কোয়ারেন্টিন সেন্টারে ভ্রাম্যমাণ আরটি-পিসিআর ল্যাবের উদ্বোধন করতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, যুক্তরাজ্যফেরত যাত্রীদের মধ্যে যাদের করোনা নেগেটিভ সনদ থাকবে না, তাদের বাধ্যতামূলক সাত দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
আশকোনার অনুষ্ঠানে মন্ত্রী আরও বলেন, সাত দিন কোয়ারেন্টিন শেষে যাত্রীদের পরীক্ষা করা হবে। পরে তারা বাড়িতে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবেন।
এরপর গত ২৮ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে এলেই ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে এই অনুশাসন দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
বৈঠকের পর সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘লন্ডন ফ্লাইট থেকে যে-ই আসুক, তার যদি আগের দিনের রিপোর্টও নেগেটিভ থাকে, তবু বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের এ নিয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা দিয়েছেন’।
আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ‘লন্ডন থেকে যারা আসবেন তাদের দুটো বিকল্প দেওয়া হবে। দিয়াবাড়ী ও হজ ক্যাম্পে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন অথবা হোটেলে নিজস্ব খরচে কোয়ারেন্টিন’।
এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার নতুন আদেশে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের সরকার নির্ধারিত হোটেলে নিজ খরচে চারদিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। কোনও যাত্রী হোটেলে যেতে না চাইলে সরকারি ব্যবস্থাপনার সেন্টারে থাকতে হবে। চারদিন পর যাত্রীদের পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা হবে। তাতে নেগেটিভ এলেও বাড়িতে গিয়ে আরও ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। পজিটিভ হলে সেই যাত্রীকে সরকার নির্ধারিত হাসপাতালের আইসোলেশনে পাঠানো হবে। হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় যাত্রীকেই বহন করতে হবে।
নতুন করে চার দিনের কোয়ারেন্টিন দেশে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াবে কি না জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস বলেন, ‘শনাক্তের হার যদি শূন্যও হয়, তবু প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয় কমপক্ষে ১০ দিন। আর করোনার জন্য ১৪ দিন বলা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে’।
তিনি বলেন, ‘আর যদি কোনও কারণে এটা সম্ভব না হয়, তবে হোম কোয়ারেন্টিনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু হোম কোয়ারেন্টিন বাংলাদেশে সম্ভব হয়নি, হবেও না। দেশে সংক্রমণ ছড়ানোর প্রধান কারণ ছিল এটি। শুরুর দিকে এটাই ছিল ভুল পদক্ষেপ। তাই আমাদের নির্ধারিত ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতেই হবে’। এর কোনও বিকল্প নেই বলে জানান চিন্ময় দাস।
গত কয়েক দিনে শনাক্তের হার কমলেও বাংলাদেশে আবার তা বাড়বে বলে মনে করেন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্যফেরতরা চারদিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন শেষে বাকি ১০ দিনের জন্য হোম কোয়ারেন্টিনে যাবেন, এমনটা ভাবলে আগের ভুলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। যে ভুল গত মার্চ-এপ্রিলে হয়েছিল।’
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার নতুন এই ভেরিয়েন্ট যদি কোনওভাবে দেশে ঢুকে পড়ে, তবে আমাদের সামনে বিপর্যয় নিশ্চিত। যে অ্যান্টিবডি আমাদের দেশে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, নতুন ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে সেটা কাজ না-ও করতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল। এটা ঠিক হয়নি’।
হোম কোয়ারেন্টিনে আমাদের দেশে কিছুই হয়নি মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘এই ভাইরাসের গতিবিধি সম্পর্কে আগাম বলা মুশকিল। সেখানে চারদিনের কোয়ারেন্টিন আরও ঝুঁকি বাড়াবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাতো এমন কিছু বলেনি। তারা কেন এই সিদ্ধান্ত নেবে’?
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘চারদিন পর যাত্রীদের আরটি-পিসিআর টেস্ট করা হবে। নেগেটিভ পেলে হোম কোয়ারেন্টিনের জন্য ছাড়া হবে। পজিটিভ পাওয়া গেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে’।
তবে শুধু যুক্তরাজ্যের যাত্রীদের ক্ষেত্রে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনের পক্ষে আমি নই মন্তব্য করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নতুন এই ভেরিয়েন্ট পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। সব যাত্রীদের জন্যই এ নিয়ম করা উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে একাধিকবার ফোন করেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার খুরশীদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

ডিসি/এসআইকে/এমএস