চট্টগ্রামে হ য ব র ল লকডাউন, হাজারো শ্রমিক-ব্যবসায়ীর বিক্ষোভ

বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
খোলা ছিল প্রায় সব ধরণের দোকানপাট।  কাপড়ের দোকান থেকে শুরু করে খাবার হোটেল, গ্যারেজ থেকে শুরু করে সব ধরণের দোকান খোলা থাকার পাশাপাশি মানুষের উপচে পড়া চলাফেরা ছিল চোখে পড়ার মতো।  মাস্ক ছাড়াই এবং অনেকের মাস্ক থাকলেও তা ছিল থুতনীতে।  খোলা স্থানে বাজার বসানোর কথা থাকলেও বদ্ধ জায়গাতেই সব সময়ের মতোই স্বাভাবিকভাবে কোনো ধরণের স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই চলেছে বাজার ও কেনাকাটা।  পথে পথে ফুটপাতে বসানো হয়েছে তরমুজ, বাঙ্গী, নানান জাতের ফলসহ হরেক রকমের পণ্যের সমাহার।  অলিতে-গলিতে চলেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটো।  এসব বাহনে গাদাগাদি করেই চড়েছেন যাত্রীরা।  পুরো চট্টগ্রামেই রিকশার রাজত্ব চোখে পড়েছে।  চোখে পড়েছে মোটরসাইকেল।  এসব রিকশা ও মোটরসাইকেলে পাশাপাশি দুই থেকে তিনজনকে চড়তে দেখা গেছে।  এসময় অনেকের মুখেই ছিল না মাস্ক।  মোড়ে মোড়ে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলগুলোর জট দেয়া গেছে।  এসব বাইকে চড়েই অনেককে কর্মস্থলে যেতে দেখা গেছে।  প্রায় দুই থেকে দশগুণ ভাড়া দিয়ে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গেছেন সাধারণ মানুষ।  চট্টগ্রামে এমনই হ য ব র ল লকডাউন বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খোদ শ্রমজীবী মানুষেরাই।  তাদের দাবি, শুধু গণপরিবহন বন্ধ ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন চোখে পড়েনি।  কিন্তু চাকুরিজীবী, শ্রমজীবী মানুষেরা গণপরিবহন না থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন।  দৈনিক কাজ করা শ্রমিকেরা মজুরি থেকে বঞ্চিত হন।

নগরের নন্দন কানন এলাকার ছবিটি তুলেছেন সৌরভ দাশ। ছবিটি নেয়া হয়েছে আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া তুতুলের ফেসবুক আইডি থেকে।

করোনা সংক্রমণ রোধে সারা দেশে সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার।  এ লক্ষ্যে নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।  কিন্তু সোমবার (৫ এপ্রিল) লকডাউনের প্রথম দিনেই দেখা গেছে অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা।  কিছু দোকান খোলা থাকলেও বেশিরভাগই ছিল বন্ধ।  অনেকেই জানেন না দোকান খোলা রাখা যাবে কিনা, আবার কেউ কেউ জানেন না কয়টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে।  প্রধান সড়কের দোকানপাট বন্ধ থাকলেও রাজধানীর অলিগলিতে চায়ের দোকান খোলা থাকায় সেখানেও মানুষের জমায়েত দেখা গেছে।  সবকিছু মিলিয়ে লকডাউনের প্রথম দিন পার হয়েছে অনেকটা হ য ব র ল অবস্থার মধ্য দিয়ে।
সোমবার ভোর থেকে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে শুরু হয়েছে লকডাউন।  মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরদিন ভোর ৬টা পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাসা থেকে বের হতে পারবেন না।  সেই সঙ্গে বন্ধ থাকবে গণপরিবহন।  এছাড়া শপিং মল বন্ধ থাকলেও কাঁচা বাজার খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  আর রেস্তোরাঁগুলোতে বসে খাবার গ্রহণের ব্যবস্থা না থাকার শর্তে খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

 

এদিকে হাজার হাজার ব্যবসায়ী-শ্রমিক বিক্ষোভ মিছিল করেছেন নগরের নিউ মার্কেট এলাকায়।  লকডাউনের নামে  মার্কেট, দোকানপাট বন্ধ রাখাার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তারা এই বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।  এসময় লোকেলোরণ্য হয়ে পড়ে নিউমার্কেট এলাকা।  পরিস্থিতি বিবেচনায় অ্যাকশনে যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। 

নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ।

গণপরিবহন না থাকায় ভোগান্তি

নগরের মুরাদপুর থেকে নিউমার্কেটে চলাচলকারী টেম্পুতে গাদাগাদি যাত্রীদের

অন্যান্য দিনের মতো চিরচেনা রূপ না থাকলেও চট্টগ্রাম নগরসহ উপজেলাগুলোর সড়ক-উপসড়কগুলোতে বাস ছাড়া সবই চলাচল করেছে।  সেইসঙ্গে রাস্তায় মানুষের চলাচলও ছিল চোখে পড়ার মতো।  কেউ দৈনন্দিন কাজে বের হয়েছেন, আবার কেউবা জীবন জীবিকার তাগিদে।  পরিবহনের চাপ কম থাকায় ট্রাফিক সিগন্যালে কাউকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না।  অফিস খোলা থাকায় আর গণপরিবহন না থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।  কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে অনেকেরই গুণতে হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বন্ধ, মোটরসাইকেল চলছে চুক্তিতে
লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণায় বন্ধ আছে রাইড শেয়ারিং সেবা।  এছাড়াও মোটরসাইকেলও বন্ধ থাকার নির্দেশনা দেয়া হয় সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে।  কিন্তু জীবিকার তাগিদে চুক্তিতেই মোটরসাইকেলে যাত্রী নিচ্ছেন মোটরসাইকেল চালকরা।  চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের এভাবেই মোটরসাইকেল চালাতে দেখা গেছে।  কর্ণেলহাট, একেখান, অলংকার, জিইসি, দুই নম্বর গেইট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, সিঅ্যান্ডবি রাস্তার মাথা, নতুন ব্রিজ, নিউ মার্কেট, লাল খান বাজার, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ মোড়সহ চট্টগ্রামের সমস্ত সড়কেই দেখা গেছে ভাড়ায় চালিত মোটরবাইকের জট।
মোটরবাইক চালক সাইফুল ইসলাম বলেন, অ্যাপ বন্ধ থাকলেও জীবিকা নির্বাহ করতে অনেকেই চুক্তিতে মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করছেন।  মোটরসাইকেলের আয়ে সংসার চলে তার।  তাই ঘরে বসে থাকার উপায় নেই বলে জানান তিনি।

খাবার-ওষুধ-নিত্যপণ্যের দোকান খোলা
চট্টগ্রাম নগরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খাবারসহ নিত্যপণ্যের দোকান খোলা ছিল।  কাঁচাবাজারেও মানুষের সমাগম দেখা গেছে প্রচুর।  প্রধান সড়কে চায়ের দোকানগুলো বন্ধ থাকলেও পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান ছিল খোলা।  তাছাড়া সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস উন্মুক্ত স্থানে বিক্রির কথা বলা হলেও পাড়া-মহল্লার দোকানিরা জানেন না তাদের দোকান কতক্ষণ খোলা রাখা যাবে।
স্বাস্থ্যবিধি পালনে অনীহা
লকডাউনে মানুষের ঘরে থাকার কথা থাকলেও কলকারখানা, অফিস খোলা থাকার ঘোষণায় বিপাকে পড়েছেন অনেকেই।  গণপরিবহন না থাকলেও চাকরি বাঁচাতে সকাল-সকাল ছুটছেন অফিসের দিকে।  কেউ কেউ মাস্ক ব্যবহার করলেও অনেকের তা থুতনিতে ঝুলতে দেখা যায়।  ভাড়ার খরচ কমাতে সিএনজি অটোরিকশায় গাদাগাদি করে ৫ জনও যেতে দেখা গেছে।  এছাড়া অনেকে আবার রিকশায় ২ জনের বদলে ৩ জন করেও চড়েছেন।

নগরের দুই নম্বর গেইটের রেলগেইট

এভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেন যাচ্ছেন জানতে চাইলে সিরাজ উদ্দিন হাওলাদার নামের এক পথচারী উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘অফিস খোলা রেখে কীসের লকডাউন, কেমন লকডাউন?  সংক্রমণ রোধ করতে চাইলে তো মানুষগুলোকে ঘরে আটকাতে হবে।  দিনের বেলা অফিস খোলা রেখে কীভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হবে, আমার বোধগম্য না’।
সকাল থেকে নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তায় বাস নেই, তবে উল্লেখযোগ্য হারে চলছে প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা এবং মোটরসাইকেল।  এছাড়া বেশ কিছু অফিসগামী যাত্রীদের নিয়ে স্টাফ বাস চলাচল করতে দেখা গেছে।  তবে এসব বাসে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো চিত্র দেখা যায়নি।  অর্থাৎ, সবাই একই সিটে পাশাপাশি বসেই অফিস যাচ্ছেন।
এছাড়া কাঁচাবাজারেরও বিক্রেতা এবং ক্রেতা কারোর মাঝে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন হতে দেখা যায়নি।  ক্রেতা কয়েকজনের মুখে মাস্ক থাকলেও বিক্রেতা কারও মুখে মাস্ক দেখা যায়নি।  নগরের কর্ণেলহাট বিপনী বিতানটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত কাঁচা বাজার।  এ বাজারের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাঁটার জো নেই।  সচেতনদের অনেকেই মাস্ক পড়লেও দোকানদার, বিক্রেতা আর তাদের সহায়ক শ্রমিকদের মুখে ছিল না মাস্ক।

ডিসি/এসআইকে/আইএস