দেশে প্রতিদিন ২০০ ‍মৃত্যু হবে- আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
আগামি ১০-১২ দিনে দেশে প্রতিদিন দুই শতাধিক করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।  দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সেবার পরিধি কম থাকায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে বলে তাদের ধারণা।
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ১১২ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।  মহামারিকালে বাংলাদেশ একদিনে এত মৃত্যু আগে দেখেনি।  সরকারি হিসেবে এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট মারা গেছেন ১০ হাজার ৪৯৭ জন।  এর আগে টানা তিন দিন মারা যান- রবিবার ১০২ জন, শনিবার ১০১ জন এবং শুক্রবার ১০১ জন। তার আগে বৃহস্পতিবার ৯৪ জন এবং বুধবার ৯৬ জন মারা যান।
স্বাস্থ্য অধিদফতর গত ৩১ মার্চ ৫২ জনের মৃত্যুর কথা জানায়।  তারপর থেকে সোমবার পর্যন্ত আর একদিনও মৃত্যুর সংখ্যা নিচে নামেনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামিতে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে আইইডিসিআর তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড-১৯ রোগের তীব্রতা আরও বেড়েছে।  যে কারণে রোগীর মৃত্যুও হচ্ছে দ্রুত।  চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে নতুন ভ্যারিয়েন্টের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাজুক অবস্থার কারণে রোগীরা সময় মতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
দেশে গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিন জন করোনা রোগী শনাক্তের খবর দেয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।  তার ঠিক ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর দেয় প্রতিষ্ঠানটি।  শুরু থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়ে যায়।  এর মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে এক হাজারের বেশি রোগী মারা যান।  এরপর গত ১৫ এপ্রিল মারা যাওয়া ৯৪ জনকে নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
গত শনিবার (১৭ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, দেশে গত সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৪৮ জন, আর চলতি সপ্তাহে মারা গেছেন ৬২২ জন।  আগের সপ্তাহের চেয়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।  এরমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে মারা গেছেন ৪৮ শতাংশ
দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তরা আগের চেয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে মারা যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।  প্রতিষ্ঠানটি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছরের চেয়ে এবার আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হারও বেড়েছে অনেক বেশি তীব্রতা নিয়ে।  আইইডিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের মার্চে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৩৮ জন, আর ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ৯৪১ জন।  মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৩২ দশমিক ২ শতাংশ।
আইইডিসিআর সংক্রমণ পরিস্থিতির বিষয়ে জানায়, এ বছরের এপ্রিলে আগের বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু হারের চেয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি মৃত্যু হয়েছে।
২০২০ এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসের সঙ্গে চলতি বছরের তিন মাসের তুলনা করে আইইডিসিআর তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে- গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কেউ মারা যাননি, মার্চে মারা গেছেন পাঁচ জন, আর এপ্রিলে মারা যান ১৬৩ জন।  কিন্তু চলতি বছরের এই তিন মাসে মারা গেছেন যথাক্রমে ২৮১, ৬৩৮ এবং ৯৪১ জন।
চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনা করে আইইডিসিআর বলছে, এ সময়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ৪৪ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, ৩৩ শতাংশ রোগী প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে, ১৭ শতাংশ রোগী বাড়িতে এবং ৬ শতাংশ রোগী অন্যান্য উপায়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
আইইডিসিআর জানায়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের ৫২ শতাংশই উপসর্গ শুরুর পাঁচ দিনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, ২৬ শতাংশ পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এবং ১২ শতাংশ উপসর্গ শুরুর ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।  হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে মারা গেছেন ৪৮ শতাংশ এবং পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে মারা গেছেন ১৬ শতাংশ রোগী।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া মানে মৃত্যু বেড়ে যাওয়া মন্তব্য করে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সংক্রমণের যে গতি-প্রকৃতি তাতে রোগতাত্ত্বিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে তার ইফেক্ট পাওয়া যায় দুই সপ্তাহ পর।  আর মৃত্যুহারের প্রভাব বোঝা যাবে তিন সপ্তাহ পরে।  সেই হিসেবে এখন যেসব সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে, তাতে গড়ে তারা দুই সপ্তাহ আগে শনাক্ত হয়েছেন।  আর এখন যাদের মৃত্যু হচ্ছে, তারা তিন সপ্তাহ আগে শনাক্ত হয়েছেন।  তবে সরকার যে কঠোর বিধিনিষেধের ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে করে মৃত্যুর হার খুবই ধীরে ধীরে নামবে, আরও তিন সপ্তাহ পরে।  তবে যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানা হয়, সেটা আবারও লাফ দিয়ে বাড়বে।  মৃত্যুর নিম্নগামীতা আমরা দেখতে পাবো ১৪ এপ্রিলের তিন সপ্তাহের মাথায়’।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আগামি ১৫ দিনের মধ্যে এটা অন্তত ২০০ (প্রতি দিনের মৃত্যু) পার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি এভাবেই চলতে থাকে’।
‘যখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্যাপাসিটি রোগী ম্যানেজমেন্ট করতে না পারে, তখন মৃত্যু বাড়বেই’- বলেন এই চিকিৎসক।  তিনি বলেন, ‘একজন রোগী হাসপাতালে আসার পর যদি ভালো কেয়ার পান, অনেক বেশি খারাপ না, আবার বেশি ভালো নয়- এধরনের রোগীদের যদি দ্রুত ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করা যায়, আইসোলেট করে ফেলা যায়, তাহলে কমিউনিটি সংক্রমিত হবে না এবং রোগীও চিকিৎসা পাবেন।  কিন্তু যখন সব হাসপাতাল ওভারলোডেড হয়ে যায়, ক্যাপাসিটি ওভারফ্লো হয়ে যায়, তখন মানুষ ঘুরতে থাকে বেড না পেয়ে’।
হেলথ সিস্টেমের এই ক্যাপাসিটি ইতোমধ্যেই ওভারফ্লো হয়ে গেছে।  এ জন্য মৃত্যুও বাড়ছে জানিয়ে ঢামেক হাসপাতালের এই চিকিৎসক বলেন, ‘সেই সঙ্গে নতুন ভ্যারিয়েন্ট এসেছে।  এই ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।  আর এসব ভ্যারিয়েন্ট কেবল দ্রুত সংক্রমণই ছড়ায় না, জটিলতাও বাড়ায়’।
পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে।  তাই এখন একটা সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে।  একইসঙ্গে বাসায় যারা মারা যাচ্ছেন, অথবা পরীক্ষা না করিয়ে মারা যাচ্ছেন, তাদের রিপোর্টিং হচ্ছে না।  অনেকে উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন সেটাও রিপোর্টিং হচ্ছে না’।  তিনি বলেন, ‘একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন শুধুমাত্র জ্বর এবং কাঁশি নিয়ে।  এই মানুষগুলো যদি না ভর্তি হতেন, তাহলে ২১ শতাংশ বেড যেগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো খালি রাখা যেতো ক্রিটিক্যাল রোগীদের ভর্তি করার জন্য’।
তাতে করে করোনা রোগীরা চিকিৎসা পেতেন।  ফলে চিকিৎসা পেলে মৃত্যু কমতো’, বলেন তিনি।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ