উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে কর্মহীনদের সহায়তায় সমন্বয় নেই, প্রস্তাব নাগরিক ফান্ডের

চসিকের উদ্যোগে জীবাণুনাশক পানি ছিটাচ্ছেন ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ।

আকবরশাহ প্রতিনিধি >>>
করোনার প্রভাবে থমকে আছে পৃথিবী। অঘোষিত লকডাউনে থমকে আছে চট্টগ্রামও। আর এই অঘোষিত লকডাউনে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। নগরের উত্তর কাট্টলীতে বসবাসকারী দিনে এনে দিনের আহার মেটানো পরিবারগুলো থাকছেন নিদারুণ অর্থনৈতিক কষ্ট মাথায় নিয়ে। নানান কারণে উত্তর কাট্টলী এলাকাটি সমৃদ্ধ এবং অপেক্ষাকৃত অর্থ-বিত্তশালীদের এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানকার স্থানীয়রা অধিকাংশই নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে কিংবা নিজেদের টাকায় কেনা ভূমিতে বাস করেন। তাদের অনেকেই দিয়েছেন ঘরভাড়া। আর এসব ঘরে ভাড়া দিয়ে বাস করেন সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা। এছাড়াও উত্তর কাট্টলীতে মাছ শিকার করে দিনাতিপাত করে জীবন চালান কিছু জেলে পরিবার। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছেন অতিদরিদ্র কিছু পরিবারও। যাদের ভূমি আছে, কিন্তু সেই ভূমিতে একটি সুন্দর ঘর করে থাকার সামর্থ নেই। অন্যদিকে এই ওয়ার্ডে বসবাসকারী কিছু পরিবার আছেন যারা ভূমির মালিক হলেও অর্থনৈতিকভাবে সামর্থহীন। তারা রিক্সা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, অন্যের জমিতে/ভবনে কামলা খেটে নিজেদের সংসার চালান। আছেন শ্রমিকও। এছাড়াও এখানে ভাড়ায় থাকা অনেক পরিবার আছেন যারা দিনে রোজগার করে দিনের চাহিদা মেটান। এই সমস্ত পরিবারগুলো এখন নিদারুণ কষ্টে আছেন। সব মিলিয়ে অন্যান্য ওয়ার্ডের মতো এই ওয়ার্ডে এখনো বলার মতো খুব বেশি দরিদ্র পরিবার নেই। এই দরিদ্রের সংখ্যা বাড়িয়েছে এখানকার কিছু ভাসমান বসবাসকারী।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে খাবার বিতরণ করেন ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ।

এদিকে এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে এই সমস্ত মানুষদের যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন সমাজের নানান প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি প্রথম দিকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে মানুষকে হাত পরিষ্কার রাখায় উদ্ভুদ্ধ করলেও তা এখন কমে গেছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে মাস্ক বিতরণও ছিল চোখে পড়ার মতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ব-উদ্যোগে অনেকে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে ফেসবুকে তা ফলাও করেছেন। অন্যরাও এ থেকে বাদ যায়নি। এখন পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তি অল্প সংখ্যক পরিবারকে চাউল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুণ, তেল, সাবান বিতরণ করেছেন যার ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছেন নিজ উদ্যোগেই।
অন্যদিকে এখানকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু নিজ উদ্যোগে এখন পর্যন্ত ২ হাজার মাস্ক, ৬০০ ডেটল সাবান বিতরণ করেছেন এলাকার মসজিদ, মন্দির এবং ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি পর্যায়ে। এর বাইরেও তিনি প্রতিদিনই সিটি কর্পোরেশন ও নিজ উদ্যোগে এলাকায় জীবাণুনাশক ছিটানো, মানুষকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ানোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। প্রতিদিনই থাকছেন মাঠে। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) তিনি নিজ উদ্যোগে এলাকার ভাসমান শ্রমজীবী মানুষদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন যা নিয়মিত করা হবে বলে জানিয়েছেন আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবু সুফিয়ান।

মাস্ক বিতরণে রফিক উদ্দিন চৌধুরী।

এছাড়াও সরকারিভাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে ওয়ার্ড পর্যায়ে বরাদ্দকৃত ৩৮২ কেজি চাউল ৭৭ টি পরিবারের মাঝে বিতরণ করেছেন কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু। এছাড়াও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে এলাকায় জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়েছে। আ’লীগ নেতা আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, সরকারি চাউলের সাথে কাউন্সিলর সাহেব ব্যক্তিগতভাবে ডাল ও আলু সংযুক্ত করে এই ৭৭ পরিবারকে দিয়েছেন। তিনি জানান, সরকারি বরাদ্দের বাইরে কাউন্সিলর সাহেব এ পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে আড়াই হাজার পরিবারকে ১৮ হাজার ১১৮ কেজি চাউল, ডাল, আলু বিতরণ করেছেন। তবে এই চাউল, ডাল আর আলুর পৃথক পরিমাণ তিনি জানাতে পারেননি।

মনোয়ার উল আলম চৌধুরীর উদ্যোগে জীবাণুনাশক ছিটানো হয়।

নারী কাউন্সিলর আবিদা আজাদকেও দরিদ্র মানুষদের পাশে দেখা না গেলেও কিছু সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে তাঁকে দেখা গেছে। সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশন থেকে কিছু বরাদ্দ পেয়ে তিনি তা বিতরণ করেছেন। তার পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে বিএনপির কাউন্সিলরপ্রার্থী রফিক উদ্দিন চৌধুরী প্রথম দিকে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করলেও এখন সেই কর্মকা- চোখে পড়ছে না। আরেকপ্রার্থী মনোয়ার উল আলম চৌধুরী নোবেলও প্রথম কয়েকদিন নিজ উদ্যোগে হ্যান্ড স্যানিটাইজেশন কর্মসূচির পাশাপাশি কয়েকটি বাড়িতে ও সড়কে জীবাণুনাশক স্প্রে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলেও তা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। এছাড়াও কিছু সামাজিক সংগঠন প্রথম দিকে বেশ সক্রিয় থাকলেও এখন আর তেমন কার্যক্রম চোখে পড়েনি স্থানীয়দের। এছাড়াও বিএনপির নারী কাউন্সিলরপ্রার্থ সখিনা বেগমকে হ্যান্ড স্যানিটাইজেশনের কিছু কর্মসূচিতে দেখা গেলেও তার পক্ষ থেকেও এখনো কোনো সহায়তা কাট্টলী ওয়ার্ডের দরিদ্র মানুষেরা পাননি। আর আওয়ামী লীগের নারী কাউন্সিলরপ্রার্থী নুরজাহান বেগমকে এখনো ওয়ার্ডে এমন কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। এছাড়াও আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এম রেজাউল করিম ও বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের পাঠানো কিছু হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক নিজ নিজ দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিতরণ করেছেন। 
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ইকবাল চৌধুরী দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, এই করোনা মহামারি কতদিন থাকবে তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানে না। আমাদের কাট্টলীতে এই করোনা দুর্যোগকালীন একটি নাগরিক ফান্ড গঠন করা খুবই জরুরি। বিচ্ছিন্নভাবে না করে আমরা যদি দল-মতের উর্ধ্বে উঠে এই নাগরিক ফান্ড গঠন করতে পারি তাহলে এই ফান্ড সংক্রান্ত যে কমিটি হবে তারা একটি প্রকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর তালিকা করে নিয়মিতভাবে সেই ফান্ড থেকে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বিতরণ করতে পারে। এতে অন্তত এই পরিবারগুলো দুর্যোগকালীন কষ্ট থেকে রক্ষা পাবেন।                                                           অন্যদিকে মোস্তফা-হাকিম ফাউন্ডেশন থেকে এখন পর্যন্ত ওয়ার্ডে দুর্যোগকালীন কোনো সহায়তা না দিলেও বড় ধরণের উদ্যোগ নিয়ে ফাউন্ডেশনটি প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে, সংকটকালীন সময়টি এখনো প্রকট নয়। আরো কিছুদিন এসব দরিদ্র মানুষ তাদের সংসার চালাতে পারবেন। এরপরই যে কঠিন সময়টি আসবে সেই সময়টিতে মোস্তফা-হাকিম ফাউন্ডেশন হতদরিদ্র মানুষগুলোর পাশে থাকতে চায়। এছাড়াও পিএইচপি ফ্যামিলির পক্ষ থেকেও এই ওয়ার্ডে কিছু ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণের কথা চলছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয়দের মতে, উত্তর কাট্টলীতে এতো বেশি দরিদ্র পরিবার নেই। যে ক’টি পরিবার দারিদ্রতার সাথে বাস করে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে দুর্যোগকালীন সহায়তাগুলো দেয়া গেলে পুরো সময়জুড়ে তাদের এই দুর্যোগের কষ্ট বুঝতে হবে না। কিন্তু, আমরা যা দেখতে পাচ্ছি কেউ বলছেন আড়াই হাজার পরিবারকে দেয়া হয়েছে, কেউ বলছেন একশো পরিবার দেয়া হয়েছে। এটা সমালোচনার সৃষ্টি করছে। এই এলাকার দরিদ্র মানুষগুলোর একটি প্রকৃত তালিকা তৈরি করে তাদের সহায়তার জন্য একটি নাগরিক ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। এই ফান্ড সংক্রান্ত গঠিত কমিটি ওয়ার্ডের প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে চিহ্নিত করে তাদের নিয়মিত খাদ্য সহায়তা দিলে যেমন ওভারলেপিং হবে না, ঠিক তেমনি এই মানুষগুলো ঘর থেকেও বের হবে না।

ডিসি/এসআইকে/এসএমআর