তথ্য ফাঁসের চিন্তা আ’লীগের নেই : শেখ হাসিনা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য কাজ করে উল্লেখ করে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের কোনো রাখঢাক (গোপনীয়) নেই। কোনো তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে, সেই চিন্তাও আমাদের নেই। আমরা যা করবো সম্পূর্ণভাবে জনগণকে জানিয়ে, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেই করবো। জনগণের কল্যাণ করাটাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য এবং সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি’।
রবিবার (২০ আগস্ট) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত ১৫ তলাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ভবন’ ও ১৩ তলাবিশিষ্ট ‘তথ্য কমিশন ভবন’ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। এছাড়া তিনি তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে একইসঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) কমপ্লেক্সেরও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতে তার সরকারের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তথ্য চাওয়া এবং তথ্য পাওয়া মানুষের অধিকার। সেই অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি এবং এখন মানুষ কোনো তথ্য চাইলে তা পেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ‘তথ্য অধিকার আইন’ পাস করে এবং এর আওতায় ‘তথ্য কমিশন’ গঠন করে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয় এবং কমিশনের নিজস্ব ভবন নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ায় দেশে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমরাই বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি ওয়ার্ল্ড এবং সংসদ টেলিভিশনের পাশাপাশি ৪৪টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও, ১৪টি আইপি টিভিসহ অসংখ্য সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টালের অনুমোদন দিয়েছি। আমরা সাংবাদিকদের কল্যাণে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৭, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪-সহ বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছি।
দেশে এখন টেলিডেনসিটি ১০৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে এখন মোবাইল গ্রাহক ১৮ কোটির ওপরে। ১৭ কোটি মানুষ কিন্তু সিম ব্যবহার হচ্ছে ১৮ কোটির ওপরে। মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৭০ লাখ।
সরকার মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সব টিভি চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। সাবমেরিন ক্যাবল কক্সবাজারে এবং কুয়াকাটায় সংযুক্ত করা হয়েছে এবং আরও একটি সংযোগের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বর্তমানে বিটিআরসির ব্যান্ডউইথ চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)-এর পাশাপাশি আরও তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্তির লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। সারা দেশে অপটিক্যাল ফাইবার বিস্তৃত হয়েছে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৩৪৮ কিলোমিটার।
তিনি যোগ করেন, বিএনপি আমলে ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালে দুই দুইবার বিনা খরচে সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। অথচ তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে এই অজুহাতে তারা এই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের পাশাপাশি ১২ বছরে বিটিআরসি শুধু তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়ে রাজস্ব আয় করেছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।
সরকার ৮ হাজার ৮৪৩টি ডিজিটাল সেন্টার এবং ৮ হাজার ৫০০টি পোস্ট ই-সেন্টার স্থাপন করেছে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার সম্প্রসারণ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার চায় বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অগ্নিসন্ত্রাসের মতো মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলা করেও আমরা উন্নয়নের পথে দেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে চাই।
এই দেশটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলাই তার সরকারের লক্ষ্য এবং এই মাসেই জাতির পিতাকে হারানোর বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে সরকার প্রধান বলেন, জাতির পিতার তৈরি করে দেওয়া ভিত্তি বা শুরু করে যাওয়া প্রতিটি কাজ সফলভাবে করতে পেরে আমি দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
তিনি বলেন, জনগণ আমাদের বারবার নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন বলেই এই কাজগুলো আমরা করতে পেরেছি। বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে আজকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার চলছে, দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। যদিও এর মাঝে আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ এবং অগ্নিসন্ত্রাস- এমন অনেক কিছুই মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে সেটাই আমরা চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এই বাংলাদেশকে আমরা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সেখানে আমাদের স্মার্ট জনগোষ্ঠী হবে, স্মার্ট ইকোনমি হবে, স্মার্ট সোসাইটি হবে, স্মার্ট গভর্নমেন্ট তথা প্রতিটি ক্ষেত্রই স্মার্ট হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তার সরকার সব ক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনগোষ্ঠী, সমাজ এবং দেশকে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছে ।
তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ, আমরা এটা সফলভাবে করতে পারবো। বাংলাদেশে কোনো ক্ষুধা-দারিদ্র্য থাকবে না, কোনো মানুষ কষ্ট পাবে না, প্রত্যেক ভূমিহীন মানুষ ঘর পাবে; প্রতিটি মানুষের জীবন মান উন্নত হবে।
সদ্য চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে অবসর ভাতা কেবল সরকারি কর্মকর্তারাই পেতো, সেটাকে আমরা এখন সর্বজনীন করে দিয়েছি। কেননা, যখন তাদের (অবসরে যাওয়া বেসরকারি কর্মজীবী) কাজ করার সুযোগ থাকবে না তখন তাদের জীবনটা যেন অর্থবহ থাকে এবং প্রত্যেক মানুষের জীবনটা যেন নিরাপদ হয়।
বিএফডিসি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাশাপাশি এক একর জমিতে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন বিটিআরসি ভবন এবং ০ দশমিক ৩৫ একর জমিতে তথ্য কমিশন ভবন উদ্বোধনের পর তিনি বলেন, আমরা যখনই কোনো উন্নয়নের উদ্যোগ নিই, তখনই দেখতে পাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ভিত্তি প্রদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ভিত্তির ওপর নির্ভর করেই আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জাতির পিতার পদচিহ্ন অনুসরণ করে বাংলাদেশ ও এর জনগণের উন্নয়নে কাজ করতে পেরে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকার ৩৫ হাজার ২৫৬টি ওয়েবসাইট সংবলিত বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘তথ্য বাতায়ন’ চালু করেছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৫৬ সালে মন্ত্রী থাকাকালে জাতির পিতার হাতেই এ দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, তার মায়েরও (বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব) এতে ভূমিকা ছিল।
সে সময় এ দেশে কলকাতাভিত্তিক বাংলা ছবির প্রদর্শনী হতো। একটি ছায়াছবি দেখে রিকশাযোগে ফেরার পথে তার মা বাবার কাছে কথা তুলেছিলেন, বাংলাদেশেও কি এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায় না? পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদে এক বিল উত্থাপনের মাধ্যমে এফডিসি প্রতিষ্ঠা করেন। জাতির পিতা গাজীপুরে ফিল্মসিটির জন্য জায়গাও বরাদ্দ দিয়ে গিয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এফডিসি নির্মিত ‘কখনো আসেনি’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘জীবন থেকে নেওয়া’র মতো জীবনমুখী চলচ্চিত্রগুলো, জহির রায়হান নির্মিত কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘ওরা ১১ জন’সহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো আমাদের দেশেই নির্মিত হয়েছে বলেও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ২০১২ সালের ৩ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চলচ্চিত্রকে ‘শিল্প’ হিসেবে তার সরকার ঘোষণা দেয়। সরকার ‘চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন আইন ২০১১’, ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (সংশোধন) আইন-২০১৯’ প্রণয়ন করেছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’। অসচ্ছল শিল্পী ও কলাকুশলীদের আর্থিক সহায়তার লক্ষ্যে ‘শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, পাশাপাশি সিনেমা হল মালিকদের দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ব্যাংক ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে চলচ্চিত্র নীতিমালা।
তিনি জানান, ‘বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ’ প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। হাতিরঝিল প্রকল্পের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্পটির ভূমি ব্যবহার করা হচ্ছে। কমপ্লেক্সের বিভিন্ন ফ্লোরে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে, যাতে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তা প্রদর্শন করার সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন।
অনুষ্ঠানে বিটিআরসি ভবন, তথ্য কমিশন ভবন এবং বিএফডিসি কমপ্লেক্স (তেজগাঁও) প্রাঙ্গণ থেকে সংশ্লিষ্টরা সংযুক্ত ছিলেন। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে নবনির্মিত বিটিআরসি ও তথ্য কমিশন ভবন এবং বিএফডিসি কমপ্লেক্সের ওপর অডিও-ভিডিও তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। খবর বাসস।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ