দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
একে-একে গ্রেফতার হচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা। কার পর কে গ্রেফতার হবেন- এ আলোচনা এখন নেতাদের মুখে। তারা চলছেন সতর্ক হয়ে; নিয়মিত ফোন ও ঠিকানা বদলে। অনেকটা সকাল-দুপুর দৌঁড়ে বেড়াচ্ছেন হেফাজতের নেতারা। সর্বশেষ রবিবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে সংগঠনটির আলোচিত-সমালোচিত যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেফতারের পর কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না। কারও-কারও ফোন খোলা থাকলেও রিসিভ করছেন অন্যকেউ।
তবে হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের একাধিক সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, গ্রেফতার হলেও এই লকডাউনের মধ্যে রমজান মাসে কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে সংগঠনটির। এ ক্ষেত্রে আপাতত আইনি পথ ও বিবৃতি দিয়েই পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া জানানোর চিন্তা রয়েছে হেফাজতের। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে হেফাজত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে তাৎক্ষণিক কর্মসূচিও ঠিক করা আছে সংগঠনটির। তাদের মতে, সরকার পবিত্র মাহে রমজানে হেফাজতকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, কি কি ঘটতে পারে- সে বিষয়ে হেফাজতও ওয়াকিবহাল। কোন সময় কোন সিদ্ধান্ত আসবে তাও ঠিক করা। সুতরাং এখনও সেই পরিস্থিতি আসেনি। সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি পর্যক্ষেণ করেই কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে।
হেফাজতের সদর দফতর হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলামের একাধিক দায়িত্বশীল জানিয়েছেন, সংগঠনের আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী মাদ্রাসাতেই আছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে তাৎক্ষণিক পরামর্শ-পর্যালোচনা করতে যাদের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই গ্রেফতার হওয়ায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে হেফাজতের আমিরও হিমশিম খাচ্ছেন বলে নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীলরা দাবি করলেও আরেকটি সূত্র বলছে- সরকার কোন পথে হাঁটবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন কৌশলে হেফাজত দমানোর কাজে যুক্ত- সবই হেফাজত নেতাদের জানা। পবিত্র রমজান মাসে সংগঠনের টার্গেটকৃত নেতাদের আটক/গ্রেফতার করলে হেফাজত কোনো কর্মসূচি দেবে না- তাও অমূলক চিন্তা। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কর্মসূচিও ঘোষণা করা আছে অভ্যন্তরীণভাবে। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় দেখা যাক।
জানতে চাইলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনে নেমেছে স্পষ্ট। হেফাজত নিয়মতান্ত্রিক, সংঘবদ্ধ কোনো সংগঠন নয়, একটি ফোরামের মতো আছে। আমি যতদূর জানি, এখনই এই পরিস্থিতিতে কোনো কর্মসূচি দেবে না হেফাজত। করোনা ভাইরাসের কারণে চলমান লকডাউন এবং পাশাপাশি রমজান মাস চলছে। ফলে এখনই কর্মসূচি দেওয়ার সুযোগ নেই’।
রবিবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেফতার হন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর কমিটির সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হক। তাকে প্রতিষ্ঠানটি দ্বিতীয় তলা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁওয়ের রয়েল রিসোর্টকাণ্ডের পর থেকেই মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান করছিলেন মামুনুল হক। এর আগে ১১ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত হেফাজতের কেন্দ্রীয় অন্তত ৮ জন নেতাকে গ্রেফতার করলো পুলিশ। তারা হলেন মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমাদ, মাওলানা মুঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, মুফতি শরীফ উল্লাহ, মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজি ও মুফতি ইলিয়াস। এছাড়া সারাদেশ থেকে অন্তত দেড়শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বিভিন্ন মামলায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুফতি আমিনীর মেয়ের জামাই মাওলানা জুবায়ের।
মাওলানা মামুনের গ্রেফতারের পর তার দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ে দলীয়ভাবে আলোচনা চলছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেওয়া না হলে দলীয়ভাবেও প্রতিবাদ সীমিত রাখা হতে পারে।
রবিবার দুপুরে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, ‘নেতারা গ্রেফতার হলে কর্মসূচির বিষয়ে আগে কোনো আলোচনা ছিল না। এখন আবার লকডাউন চলছে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত আসবে’।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলরা বলছেন, মামুনুলের গ্রেফতারের পর থেকে ঢাকার নেতারা অনেকটা গা ঢাকা দিয়েছেন। নিজেদের ফোন বন্ধ রেখে যে যার মতো নিরাপদে অবস্থান নিতে শুরু করেছেন।
রবিবার দুপুর থেকে হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম, নায়েবে আমির, যুগ্ম ও সহকারী মহাসচিবসহ অন্তত একডজন নেতাকে ফোন করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
ঢাকা মহানগরের এক নেতা বলেন, ‘১৯৯৯ সালে ফতোয়া নিষিদ্ধের হাইকোর্টের রায়ের পর আন্দোলনের সময় ধর্মভিত্তিক দলের নেতারা গণহারে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এর ২০ বছর পর আবারও সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা। তবে ধর্মভিত্তিক দল ও আলেমদের মধ্যে যূথবদ্ধতা না থাকায় সম্মিলিত প্রতিবাদ করতে পারছে না হেফাজত’।
ঢাকার কয়েকটি কওমি মাদ্রাসা ও নারী কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকেও খবর পাওয়া গেছে, ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য চাওয়া হচ্ছে নিকটস্থ থানা থেকে।
সরকারের প্রভাবশালী একটি সংস্থার সূত্র জানায়, হেফাজতের নেতাদের ধরপাকড় প্রক্রিয়া আরও চলবে। বিশেষ করে করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনের সময় গত ২৫, ২৬, ২৭ মার্চ তিন দিন ধরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে নাশকতা চালানো হয়েছে, এসব নাশকতার পেছনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যাদের ভূমিকা পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরই আইনের আওতায় আনবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
হেফাজতের নায়েবে আমির অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘আমরা আইনগতভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার করার চিন্তা করছি। ইতোমধ্যে পারিবারিকভাবে আইনি পথে সহযোগিতা নেওয়া শুরু হয়েছে। এটা আমরা সাংগঠনিকভাবেও অব্যাহত রাখার চেষ্টা করবো’।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পুরো হেফাজতে ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। কখন কাকে ধরবে পুলিশ, এ নিয়ে বিস্তর দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে সেখানে অবস্থানরত নেতাদের। স্থানীয় নেতারা ইতোমধ্যে নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে গোপনে অবস্থান করছেন। ইতোমধ্যে স্থানীয় দোকানদার, ছাত্রলীগনেতা, শফীপন্থী সংগঠকদের গ্রেফতারের কারণে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পড়েছেন নেতারা। ফলে, কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তেই যেতে পারছেন না মাওলানা বাবুনগরী ও হেফাজতের শীর্ষনেতারা। তবে আজ বিবৃতির মাধ্যমে মামুনুল হকসহ অন্যদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানাতে পারেন হেফাজতের আমির মাওলানা বাবুনগরী।
জানতে চাইলে হেফাজতের প্রেস সেক্রেটারি মাওলানা ইনআ’মুল হাসান ফারুকী বলেন, ‘কর্মসূচি বা বিবৃতির বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্তের কথা আমি জানি না। আমিরে হেফাজত পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। কোনো সিদ্ধান্ত হলে আমরা জানিয়ে দেবো’।
ডিসি/এসআইকে/এমএসএ