রোজা রেখে কি করা যাবে, কি করা যাবে না প্রশ্নের উত্তর

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
মহিমান্বিত পবিত্র রমজান মাস চলছে।  এই মাসে কোরআন শরীফ নাজিল হয়েছিল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর।  ইসলামে এই মাসের যে ফজিলত, তা প্রত্যেক মুসলমানকেই মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে।  আর এই রমজানকে ঘিরে আমাদের মধ্যে নানাবিধ প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।  এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।  প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন মাওলানা মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী, দাওরায়ে হাদিস, দারুল উলুম দেওবন্দ, উত্তর প্রদেশ, ভারত।  ইফতা, জামিয়া আন‌ওয়ারুল হুদা, হায়দারাবাদ, ভারত। খতিব, পীর ইয়ামেনী জামে মসজিদ, গুলিস্তান, ঢাকা।  মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগ মাদ্রাসা, রামপুরা, ঢাকা।

প্রশ্ন : রোজা রেখে চুল-নখ কাটা যাবে কি?
উত্তর : রোজা ভঙ্গের কারণ হচ্ছে স্বাভাবিক প্রবেশপথ দিয়ে পেটে বা মস্তিষ্কে কোনও কিছু প্রবেশ করা।  রোজা রেখে চুল ও নখ কাটা যাবে।  রোজা রেখে চুল ও নখ কাটার দ্বারা রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।  (তথ্যসূত্র: বায়হাকি শরিফ, হাদিস নং-৮৫১২, ফতহুল বারি, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২০৭, কিতাবুল ফাতাওয়া, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৮৬)
প্রশ্ন : রোজা রেখে আতর, সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করা যাবে কি?
উত্তর : রোজা ভঙ্গের কারণ হচ্ছে স্বাভাবিক প্রবেশপথ দিয়ে পেটে বা মস্তিষ্কে কোনো জিনিস প্রবেশ করা।  আতর বা পারফিউমের ঘ্রাণ নেওয়ার কারণে সরাসরি তা শরীরে প্রবেশ করে না।  তাই রোজা রেখে আতর, সুগন্ধি ও পারফিউম ব্যবহার করলে রোজা ভঙ্গ হবে না।  হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম সা. রোজাদারকে সুগন্ধি দিয়ে মেহমানদারীর কথা বলেছেন।
মনে রাখবেন, আতর ব্যবহার করা সুন্নত।  তবে পারফিউমে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়।  তাই পারফিউম ব্যবহার করার আগে কিছু জিনিস জানতে হবে।  যেমন- খেজুর বা আঙুরের রস থেকে তৈরি অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় অপবিত্র।  তাই তার ব্যবহার জায়েজ নেই।  যদি এটি অন্য কোনও জিনিস থেকে তৈরি করা হয়, তাহলে তা পবিত্র।  তার ব্যবহার জায়েজ আছে।  আজকাল পারফিউমে যে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়, তা খেজুর বা আঙুর থেকে প্রস্তুত করা হয় না।  এগুলো তৈরি হয় সাধারণত চাল, গম, পেট্রল ও আলু থেকে।  তাই এমন পারফিউম নাপাক নয়।  এগুলো ব্যবহারে কাপড়ও নাপাক হবে না।  এমন পারফিউম লাগানো কাপড়ে নামাজ পড়া যাবে।  তবে এক্ষেত্রে অ্যালকোহল ও অ্যালকোহলিক পানীয়কে এক মনে করা যাবে না।  (তথ্যসূত্র : বায়হাকি শরিফ, হাদিস নং-৩৯৬০, ফতহুল বারি, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২০৭, তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম : খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৬০৮, কিতাবুল ফাতাওয়া খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৯৩)
প্রশ্ন : হাত-পা কেটে বেশ রক্ত পড়েছে, রোজা কি ভেঙে যাবে?
উত্তর : রোজা ভঙ্গের কারণ হচ্ছে, স্বাভাবিক প্রবেশ পথ দিয়ে পেটে বা মস্তিষ্কে কোনো কিছু প্রবেশ করানো।  শরীর থেকে কোনো কিছু বের হলে রোজা ভঙ্গ হয় না।  তাই দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে হাত-পা কেটে রক্ত পড়লে রোজা ভাঙবে না।  (তথ্যসূত্র: বোখারি শরিফ, হাদিস নং-১৯৩৮, মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-১১০৬,আবু দাউদ শরিফ, হাদিস নং-২৩৭২, বায়হাকি শরিফ, হাদিস নং-৩৯৬০)
প্রশ্ন : সেহরিতে কিছু না খেলে রোজা হবে?
উত্তর : ইসলামের দৃষ্টিতে রোজার নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম রোজা।  সেহরি খাওয়া রোজার জন্য শর্ত নয়।  তাই সেহরি না খেলেও রোজা হয়ে যাবে।  তবে মনে রাখবেন, সেহরি খাওয়া সুন্নত।  অল্প খেলেও সুন্নত পালন হয়ে যাবে।
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, সেহরি খাওয়ার মাঝে রয়েছে অনেক বরকত।  যারা সেহরি খায়, তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর দয়া ও ফেরেশতাদের দোয়া।  তাই সেহরিকে সুন্নত মনে করে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা উচিত।  (তথ্যসূত্র: সুরা বাকারা, আয়াত নং-১৮৭, বোখারি শরিফ, হাদিস নং-১৯২৩ ,মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-১০৯৫ ,সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং-৩৪৬৭, হেদায়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২১৬)
প্রশ্ন : রোজা রেখে টিকা বা ইনসুলিন নেওয়া যাবে?
উত্তর : রোজা অবস্থায় ইনসুলিন/ইনজেকশন নেওয়া যাবে।  এতে রোজা ভঙ্গ হবে না।  রোজা ভঙ্গের কারণ হচ্ছে, স্বাভাবিক প্রবেশপথ দিয়ে শরীরে (পেট বা সরাসরি নাকের মাধ্যমে মস্তিষ্কে) কোনো কিছু প্রবেশ করানো।  অস্বাভাবিক প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে কোনো কিছু প্রবেশ করলে রোজা ভঙ্গ হয় না।  ইনসুলিন দেওয়া হয় ত্বকে, এতে শরীরের শক্তিও বাড়ে না।  আবার যেসকল প্রাণরক্ষাকারী ইনজেকশন বা টিকা রগে বা মাংসে দেওয়া হয়, সেগুলোতেও রোজা ভাঙবে না।  আবার কারও যদি রক্তনালীতে শক্তিবর্ধক গ্লুকোজ স্যালাইন নিতে হয়, সেক্ষেত্রে রোজা মাকরুহ হবে, তবে ভাঙবে না।  (তথ্যসূত্র: হেদায়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২০০, কিতাবুল ফাতাওয়া, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৯১)
প্রশ্ন : কোনো ব্যক্তি সেহরি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। সারাদিন ঘুমিয়েই কাটালো। কোনো ওয়াক্তের নামাজও পড়েনি। তার রোজা কি হবে?
উত্তর : ইসলামের দৃষ্টিতে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম রোজা।  সেহরি খেয়ে রোজার নিয়ত করে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে রোজা হয়ে যাবে।  তবে নামাজ একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, ওটা ছেড়ে দেওয়ার কারণে গুনাহগার হবে।  (তথ্যসূত্র: সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৭, কিতাবুল ফাতাওয়া, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪২৫)
প্রশ্ন : ধরা যাক সেহরি খাচ্ছেন। মুখের ভেতর তখনও খাবার, এমন সময় ফজরের আজান দিলো। কী করবেন?
উত্তর : সেহরির শেষ সময় হচ্ছে সুবহে সাদিক।  ফজরের ওয়াক্তও শুরু হয় সুবেহ সাদিক থেকে।  যখন‌ই সেহরির সময় শেষ, তখনই ফজরের সময় শুরু।  ফজরের আজানের সঙ্গে সেহরির শেষ ওয়াক্তের সরাসরি সম্পর্ক নেই।  যদি মুয়াজ্জিন সুবহে সাদিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফজরের আজান দিয়ে থাকেন, তবে ওই অবস্থায় খানাপিনা বন্ধ করে দেবেন।  মুখের খাবারও ফেলে দেবেন।  যদি তা গিলে ফেলেন, তবে রোজা ভঙ্গ হবে।  (তথ্যসূত্র: সুরা বাকারা, আয়াত নং-১৮৭, হেদায়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২১৬, কিতাবুল ফাতাওয়া, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪২৬)
প্রশ্ন : রোজা রেখে রক্ত দেওয়া যাবে কি?
‌উত্তর : রোজা ভঙ্গের কারণ হচ্ছে স্বাভাবিক প্রবেশ পথ দিয়ে শরীরে কোনো কিছু প্রবেশ করানো। শরীর থেকে কিছু বের হলে রোজা ভঙ্গ হয় না। তাই রক্ত দিলে রোজা ভঙ্গ হবে না। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজা রেখে সিঙ্গা লাগিছেন। তা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সিঙ্গার মাধ্যমে শরীরের বিষাক্ত রক্ত বের করা হয়। তাই রোজা রেখে নিজের টেস্ট/পরীক্ষার জন্য কিংবা কোনো রোগীকে দেওয়ার জন্য রক্ত দিলে, রোজার ক্ষতি হবে না। তবে রক্ত দিতে গিয়ে দুর্বল হলে রোজা ভেঙে ফেলার আশঙ্কা থাকলে। সেই অবস্থায় রক্ত দেওয়া মাকরূহ হবে। (তথ্যসূত্র: বোখারি শরিফ, হাদিস নং-১৯৩৮, মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-১১০৬,আবু দাউদ শরিফ, হাদিস নং-২৩৭২)

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ