‘অসাধ্য সাধন’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের

ক্রীড়া ডেস্ক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
এমন এক টেস্টও হেরে গেল বাংলাদেশ!  যে টেস্টে টাইগারদের জয় বলতে গেলে চোখের সামনেই ছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ খুব ভালো খেললে বড়জোড় ড্র হতে পারে, এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন প্রায় সবাই।
অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভাবলো অন্যরকম।  অসাধ্য সাধন করল অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা দেখিয়ে।  ক্যারিবীয়দের জয়ের নায়ক অভিষিক্ত কাইল মায়ারস।  তার মহাকাব্যিক এক ডাবল সেঞ্চুরিতে ভর করেই ৩ উইকেট হাতে রেখেই হেসেখেলে মাঠ ছেড়েছে সফরকারিরা।  এই জয়ে দুই ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেছে ক্রেইগ ব্রাথওয়েটের দল।
লক্ষ্য ছিল ৩৯৫ রানের।  পঞ্চম দিনের শেষ ঘন্টাতেও বোঝা যাচ্ছিল না, শেষ হাসি হাসবে কে।  শেষতক সেই হাসিটা হাসল ক্যারিবীয়রাই।  হতাশায় ডুবাল ঘরের মাঠের বাংলাদেশকে।
অভিষিক্ত কাইল মায়ারসের ব্যাটে বিষাদের বিউগল বাজল টাইগার শিবিরে আর উল্টো চিত্র ক্যারিবীয়দের ডাগআউটে।  ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল দল এলে হয়তো সুযোগই পেতেন না মায়ারস, সেই তিনিই হলেন ক্যারিবীয়দের অবিস্মরণীয় জয়ের অবিসংবাদিত নায়ক।
প্রায় আড়াইশ বছরের টেস্ট ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতার নজির রয়েছে মাত্র ৪টি।  আজ রবিবার (৭ ফেব্রুয়ারি) ইতিহাসের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।  টেস্টে সর্বোচ্চ ৪১৮ রান তাড়া করে জয়ের বিশ্বরেকর্ডটাও ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই দখলে।  নাঈম হাসানের বলে মিড অনে ঠেলে দিয়ে দ্রুত সিঙ্গেল নিয়ে আজকের জয়টি নিশ্চিত করেছেন মায়ারস।
ম্যাচের শেষ দিন জয়ের জন্য ৭ উইকেট হাতে নিয়ে ২৮৫ রান প্রয়োজন ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের।  চতুর্থ উইকেট জুটিতে রেকর্ড ২১৬ রান যোগ করে ম্যাচ সহজ করেন এনক্রুমাহ বোনার ও কাইল মায়ারস।  পরে ষষ্ঠ উইকেটের ১০০ রানের জুটি গড়ে বাকি কাজ সারেন মায়ারস ও জশুয়া ডা সিলভা।  শেষপর্যন্ত মায়ারস ২১০ রানে অপরাজিত থাকেন।  বোনারের ব্যাট থেকে আসে ৮৬ রান।
অথচ আজ দিনের প্রথম সেশনের প্রথম ঘণ্টায় একাধিক সুযোগ তৈরি করেছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ ও তাইজুল ইসলাম।  কিন্তু কখনও রিভিউ না নেয়ার ভুল, আবার কখনও ক্যাচ ছেড়ে ক্যারিবীয়দের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ।  যার সুবাদে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যায় সফরকারীরা।
চতুর্থদিন করা ৩ উইকেটে ১১০ রান নিয়ে দিনের খেলা শুরু করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।  আজ দুই প্রান্ত থেকে মেহেদি মিরাজ ও তাইজুলকে দিয়ে আক্রমণ শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হক।  প্রথম সেশনে মেলেনি সাফল্য, সুযোগ পেয়ে মায়ারস ও বোনার অবিচ্ছিন্ন জুটিতে যোগ করেছেন ১৩৮ রান।
মেহেদি মিরাজের বলে স্লিপে দাঁড়িয়ে হাফসেঞ্চুরিয়ান মায়ারসের ক্যাচ ছেড়ে দিয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। সে বলে পাওয়া সিঙ্গেল থেকে ফিফটি পূরণ হয় মায়ারসের।  এছাড়া ইনিংসের ৫০তম ওভারে তাইজুলের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদেও পড়েছিলেন মায়ারস।  আম্পায়ার আউট দেননি, রিভিউও নেয়নি বাংলাদেশ।  কিন্তু সেই বলটি আঘাত হানত লেগস্ট্যাম্পে।  ফলে সুযোগ পান মায়ারস।
সেশন শেষ হওয়ার ওভারে রিভিউ না নেয়ার ভুল করেনি বাংলাদেশ।  এবারও বোলার ছিলেন তাইজুল, ব্যাটসম্যান মায়ারস এবং আম্পায়ারের সিদ্ধান্তও ছিল নটআউট।  টাইগাররা রিভিউ নিলে দেখা যায়, সেই বলের উইকেটস ছিল আম্পায়ারস।  অর্থাৎ আম্পায়ার আউট দিলে সাজঘরে ফিরতে হতো মায়ারসকে।  কিন্তু আম্পায়ার আউট না দেয়ায় সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছেন বাঁহাতি এ ব্যাটসম্যান।
শুধু মায়ারস একা নন।  বাংলাদেশের রিভিউ ভুলে বেঁচেছেন বোনারও।  ইনিংসের ৫৬তম ওভারে নাঈম হাসানের দুর্দান্ত টার্নিং ডেলিভারি গিয়ে আঘাত হানে বোনারের পায়ে।  বল লেগস্ট্যাম্প দিয়ে বের হয়ে যাবে ভেবে আউট দেননি আম্পায়ার, বাংলাদেশও নেয়নি রিভিউ।  রিপ্লেতে দেখা যায়, সে বলটিও লেগস্ট্যাম্পে লাগত।  ফলে মায়ারসের মতো বেঁচে যান বোনারও।
দিনের প্রথম ঘণ্টার পর দ্বিতীয় ঘণ্টার খেলার শুরুতে প্রথমবারের মতো আক্রমণে আনা হয় মোস্তাফিজুর রহমানকে।  তার ওভারেই ইনিংসের প্রথম ছক্কাটি হাঁকান মায়ারস।  সেই ওভার থেকে ক্যারিবীয়রা পায় ১১ রান।  সেই স্পেলে তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি মোস্তাফিজ।
অন্যদিকে স্পিনেও আর তেমন কোনো পরীক্ষা নিতে পারেননি মিরাজ-নাঈম-তাইজুলরা।  হাড়ে হাড়ে অনুভূত হয়েছে সাকিব আল হাসানের অভাব।  অবশ্য একই সঙ্গে ভাগ্যবানও ছিলেন ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা।  ইনিংসের ৮২তম ওভারে তাইজুলের বলে বোনারকে লেগ বিফোরে আউট দিয়েছিলেন আম্পায়ার।  কিন্তু রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান বোনার।
এর পরের ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে জাদুকরী তিন অঙ্কের দেখা পান মায়ারস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৪তম ও বিশ্বের ১০৭তম খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরি করলেন তিনি।  শতক হাঁকিয়েও তেমন কোনো ঝুঁকি নেননি মায়ারস, দেননি কোনো সুযোগ।  যার ফলে বারবার হতাশায় ডুবতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে।
অন্য পাশে বোনার দেখান দৃঢ়তার অনন্য প্রদর্শনী। মায়ারস রানের চাকা সচল রেখেছেন নিয়মিত বাউন্ডারি হাঁকিয়ে।  কিন্তু বোনার খুব বেশি আক্রমণাত্মক শট খেলেননি।  তাদের দুজনের যুগলবন্দীতে জয়ের ভিতটা পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।  তবে মায়ারস নিজের অভিষেকে সেঞ্চুরি পেলেও, তা করতে পারেননি বোনার।
তাইজুল ইসলামের করা শেষ সেশনের প্রথম ওভারের পঞ্চম বলে ছক্কা হাঁকান সেঞ্চুরির কাছাকাছি থাকা এনক্রুমাহ বোনার।  কিন্তু পরের বলেই তাকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন তাইজুল।  সাজঘরে ফিরে যান ২৪৫ বলে ৮৬ রান করা বোনার।  তার বিদায়ে ভাঙে মায়ারস-বোনারের ২১৬ রানের চতুর্থ উইকেট জুটি।
বোনারের বিদায়ে ভাঙে ২১৬ রানের চতুর্থ উইকেট জুটি।  টেস্ট ইতিহাসে ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের জুটির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন মায়ারস ও বোনার।  প্রায় দেড়শ বছরের টেস্ট ইতিহাসে চতুর্থ ইনিংসে তাদের চেয়ে বেশি রানের জুটি রয়েছে মাত্র ৮টি।  এছাড়া দুই অভিষিক্ত ব্যাটসম্যানের জুটিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে গেছেন তারা।  টেস্ট ক্রিকেটে দুই অভিষিক্ত ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড ২৪৯ রানের।
ছয় নম্বরে ব্যাট করতে উইকেটে আসেন প্রথম ইনিংসের হাফসেঞ্চুরিয়ান জার্মেইন ব্ল্যাকউড।  তখন ম্যাচ জেতার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ছিল ৩২ ওভারে ১২০ রান।  ব্যাটিংয়ে নেমে শুরু থেকেই আক্রমণে যান ব্ল্যাকউড।  কিন্তু পারেননি বেশিক্ষণ খেলতে।  ব্ল্যাকউড এক ছক্কা হাঁকানোর পর তার বিদায়ঘণ্টা বাজান নাঈম।  উইকেট ছেড়ে এগিয়ে এসে বড় শট মারতে গিয়ে সরাসরি বোল্ড হয়ে যান ৯ রান করা ব্ল্যাকউড।
এরপর আর বাংলাদেশকে সুযোগ দেয়নি মায়ারস ও জশুয়া ডা সিলভা।  তাদের ১০০ রানের ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে সহজেই ম্যাচের ফল নিশ্চিত করে ফেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।  জয়ের জন্য তিন রান বাকি থাকতে সরাসরি বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরে যান ২০ রান করা জশুয়া।  এতে অবশ্য জয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যাই হয়নি ক্যারিবীয়দের।
জশুয়া আউট হওয়ার আগেই অবিস্মরণীয় এ জয়ের নায়ক অবিসংবাদিত নায়ক কাইল মায়ারস তুলে নিয়েছেন ডাবল সেঞ্চুরি।  ম্যাচের উইনিং শট নিয়ে তিনি অপরাজিত থাকেন ২১০ রানে।  টেস্ট ইতিহাসে অভিষেক ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি করা ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান তিনি।  আর অভিষিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে চতুর্থ ইনিংসে বিশ্বের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরির মালিক হলেন তিনি।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ