ইতালিকে উড়িয়েই জিতলো আর্জেন্টিনা

ক্রীড়া ডেস্ক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার সামনে পাত্তাই পেলো না ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি।  দুই মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়নের লড়াইয়ে ৩-০ গোলের সহজ জয় পেলো আর্জেন্টিনা।  লাউতারো মার্টিনেজ, অ্যাঞ্জেলো ডি মারিয়া ও পাওলো দিবালার গোলে ফাইনালিসিমা জিতে নিলো আলবিসেলেস্তেরা।
সবশেষ ১৯৯৩ সালে হয়েছিল ফাইনালিসিমা ম্যাচ।  সেবার ইউরো চ্যাম্পিয়ন ডেনমার্ককে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনা।  প্রায় ২৯ বছর পর আবারও চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, এবার তারা হারালো ইতালিকে।  এ নিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে টানা ৩২ ম্যাচ অপরাজিত রইলো আর্জেন্টিনা।
ম্যাচের স্কোরলাইন হতে পারতো ৫-০, ৬-০ কিংবা আরও বেশি।  কিন্তু আর্জেন্টিনার সামনে বারবার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন ইতালির গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডনারুম্মা।  তার শক্ত প্রাচীর ভেদ করেই তিনবার জালের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে লিওনেল স্কালোনির শিষ্যরা।
গোলের দেখা না পেলেও পুরো ম্যাচে অসাধারণ খেলেছেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসি।  অল্পের জন্য কয়েকবার গোলবঞ্চিত হয়েছেন তিনি।  তবে জোড়া অ্যাসিস্ট করেছেন মেসি।  এক গোলের পাশাপাশি মার্টিনেজ করেছেন একটি অ্যাসিস্ট।
ইতালিকে এই ফাইনালিসিমায় হারানোর মাধ্যমে এক বছরের ব্যবধানে দুইটি আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতে নিলো আর্জেন্টিনা।  ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকার পর মাঝের ২৮ বছর তাদের ছিল না কোনো শিরোপা।  গতবছর কোপা জেতার পর এবার ফাইনালিসিমা জিতলেন মেসিরা।
লন্ডনের ওয়েম্বলিতে ইউরো চ্যাম্পিয়ন ও কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়নদের এ লড়াইয়ে শুরু থেকেই আধিপত্য রেখে খেলেছে আর্জেন্টিনা।  ম্যাচের প্রথম দশ মিনিট বারবার ইতালির রক্ষণে হানা দিয়েছেন লিওনেল মেসি, অ্যাঞ্জেলো ডি মারিয়ারা।
নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে ইতালিও আক্রমণে ওঠে ২০ মিনিটের মাথায়।  ডিফেন্ডার ক্রিশ্চিয়ানো রোমেরো ও গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের কল্যাণে সে দফায় বিপদ ঘটেনি আর্জেন্টিনার, ভালো সুযোগ তৈরি করেও জালের ঠিকানা খুঁজে নিতে পারেনি ইতালি।
অবশেষে ২৮ মিনিটের সময় আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। দারুণ এক টার্ন নিয়ে কাছে ঘেঁষে থাকা ডিফেন্ডার ডি লরেঞ্জোকে পরাস্ত করেন মেসি।  বাম পাশ দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সামনে এগিয়ে বল বাড়িয়ে দেন ডি-বক্সে অপেক্ষায় থাকা লাউতারো মার্টিনেজের কাছে।
ঠিক গোলমুখে ওৎ পেতে থাকা মার্টিনেজকে বেশি কিছু করতে হয়নি।  শুধু ঠিকঠাক পা লাগিয়ে গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডনারুম্মাকে পরাস্ত করেন মার্টিনেজ, উল্লাসে মাতে পুরো আর্জেন্টাইন শিবির। আর্জেন্টিনার জার্সিতে মার্টিনেজের এটি ২০তম গোল।
এক গোলের লিড নিয়ে যেনো স্বস্তিতে থাকতে পারেনি আর্জেন্টিনা।  তাই এগিয়ে গিয়েও কমায়নি আক্রমণের তেজ।  অন্যদিকে পিছিয়ে পড়ে ইতালিও খুঁজতে থাকে গোলের সুযোগ।  ম্যাচের ৩৯ মিনিটের মাথায় মেসিকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন ইতালির লেওনার্দো বনুচ্চি।
সেই বনুচ্চির সামনে দিয়েই হয় দ্বিতীয় গোলের আক্রমণের সূচনা।  মার্টিনেজকে আটকানোর দায়িত্বে ব্যর্থ হন বনুচ্চি।  বল নিয়ে সোজা ওপরে উঠে যান মার্টিনেজ, তাকে সহায়তা করতে ডান দিক দিয়ে ওপরে ওঠে ডি মারিয়াও।
ডি-বক্সের কাছে গিয়ে দুই ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে ডি মারিয়ার উদ্দেশ্যে বল এগিয়ে দেন মার্টিনেজ।  সেই বল থেকে আলতো চিপ করে ডনারুম্মার মাথার ওপর দিয়ে বল জালে জড়ান ডি মারিয়া।  এই গোলে বিরতিতে যাওয়ার আগে স্বস্তি খুঁজে পায় আর্জেন্টিনা।
নিজেদের শেষ ১৮ ম্যাচে এক গোলের বেশি হজম করেনি আর্জেন্টিনা।  তাই দ্বিতীয়ার্ধে ইতালির সামনে কাজটা ছিল বেশ কঠিন।  সেই মিশনে নামার আগে একসঙ্গে তিন পরিবর্তন করে ইতালি।  দেশের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলতে নামা অধিনায়ক জর্জিনিও কিয়েল্লিনির জায়গায় নামানো হয় ম্যানুয়েল লাজ্জানিকে।
এছাড়া ফেডেরিক বার্নার্দেস্কি ও আন্দ্রে বেলোত্তির জায়গায় ম্যানুয়েল লোকাতেল্লি ও জিয়ানলুকা চামাক্কাকে মাঠে নামান ইতালির কোচ রবার্তো মানচিনি।  অন্যদিকে দুই গোলের লিড থাকায় প্রথমার্ধের একাদশ অপরিবর্তিত রাখেন আর্জেন্টাইন কোচ।
দ্বিতীয়ার্ধে ফিরে ৫৫ মিনিটের মাথায় আত্মঘাতী গোল হজম করতে বসেছিল ইতালি।  মার্টিনেজের পাস ঠিকঠাক ধরতে পারেননি মেসি।  তার পায়ে লেগে বল চলে যায় বনুচ্চির কাছে।  এ অভিজ্ঞ ডিফেন্ডারের ভুল ব্যাকপাসে বল প্রায় জালে জড়িয়েই যাচ্ছিল, গোললাইন থেকে ফেরান ডনারুম্মা।
মিনিট দুয়েক পর বক্সের বাইরে থেকে আচমকা শটে আর্জেন্টাইন রক্ষণকে চমকে দিয়েছিলেন বদলি হিসেবে নামা লোকাতেল্লি।  তবে গোলবারের নিচে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় পরম নির্ভরতায় সেটি গ্লাভসবন্দী করেন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
লোকাতেল্লির এই শট যেনো তাতিয়ে দেয় আর্জেন্টিনাকে।  মাত্র ছয় মিনিটের মধ্যে গোলের চারটি জোরালো সুযোগ তৈরি করে তারা।  ম্যাচের ৬০ মিনিটের মাথায় ডি মারিয়ার উদ্দেশ্যে লং বল এগিয়ে দেন ওটামেন্ডি।  সেটি ধরে দ্রুততার সঙ্গে ডান পাশ দিয়ে বক্সে ঢুকে যান ডি মারিয়া।
তার বাম পায়ের বাঁকানো শট ঝাঁপিয়ে পড়ে কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান ইতালির গোলরক্ষক।  সেই কর্নারেই মেসির ক্রসে বাম পায়ের জোরালো ভলি করেন ডি মারিয়া।  আরও একবার কোনোমতে নিজ দলকে বাঁচান ডি মারিয়া-মেসিদের পিএসজি সতীর্থ ডনারুম্মা।
এখানেই শেষ নয়।  ম্যাচের ৬৪ মিনিটের সময় নাহুয়েল মোলিনার বুদ্ধিদীপ্ত পাসে ডি-বক্সের মুখে ডান পাশে বল পেয়ে যান মেসি। ডি-বক্সের মধ্যে অপেক্ষায় ছিলেন জিওভান্নি লো সেলসো।  তার উদ্দেশ্যে বল এগিয়ে দেন মেসি।  কিন্তু সেটি জালে রাখতে পারেননি লো সেলসো।
পরের মিনিটে প্রায় মাঝমাঠ থেকে ড্রিবলিং করে ডি-বক্সে ঢুকে যান মেসি।  মনে হচ্ছিল ডি-বক্সে থাকা সতীর্থ কাউকে খুঁজে নেবেন তিনি।  কিন্তু আচমকা শটে ইতালির রক্ষণকে হকচকিয়ে দেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক।  তবে ডনারুম্মার সজাগ দৃষ্টি এড়াতে পারেননি মেসি।
আক্রমণের ছন্দে থাকা আলবিসেলেস্তেরা চার মিনিট পর আবারও ইতালির রক্ষণে কাঁপন ধরায়।  অধিনায়কের উদ্দেশ্যে বল এগিয়ে দেন মার্টিনেজ।  ডি-বক্সের বাইরে থেকে বাম পায়ের বাঁকানো শট নেন মেসি।  বাম দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটি জালে ঢুকতে দেননি ডনারুম্মা।
একের পর এক আক্রমণে দিশেহারা ইতালিকে বাধ্য হয়েই বেছে নিতে হয় ফাউলের পথ।  ম্যাচের ৭৩ মিনিটে মেসিকে কড়া ট্যাকল করে হলুদ কার্ড দেখেন ডি লোরেঞ্জো।  চার মিনিট পর ডি মারিয়াকে ফাউল করে কার্ড দেখেন নিকোলো বারেল্লা।
এ দুই কার্ডের মাঝে মিডফিল্ডার রদ্রিগো ডি পলকে তুলে নিয়ে এজেকুয়েল প্যালাসিওসকে নামান আর্জেন্টিনার কোচ।  ডি পল মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সময় ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, ‘ডি মারিয়া-মেসির জন্য অবশ্যই একজন ডি পলের খুব প্রয়োজন’।  এতেই বোঝা যায় মাঠের ডি পলের প্রভাব।
ডি পল উঠে গেলেও কমেনি আর্জেন্টিনার আক্রমণ।  ম্যাচের ৮১ মিনিটে ডি মারিয়ার পাস থেকে ডি-বক্সে দাঁড়িয়ে বাঁকানো শট নেন লো সেলসো।  হেডে সেটি ক্লিয়ার করেন ডি লোরেঞ্জো।  এক মিনিট পর মেসির বাম পায়ের জোরানো শট ব্লক করেন লোকাতেল্লি।
ম্যাচের তখন বাকি দশ মিনিটেরও কম।  তখন জোড়া পরিবর্তন করে আর্জেন্টিনা।  ক্রিশ্চিয়ান রোমেরোর জায়গায় জার্মান পেজ্জেল্লা ও লাউতারো মার্টিনেজের বদলে আসেন হুলিয়ান আলভারেজ।  মাঠে নেমে দুই মিনিটের মধ্যেই গোলের জন্য শট নেন আলভারেজ।
নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হওয়ার পর দেওয়া হয় অতিরিক্ত চার মিনিট।  এর প্রথম মিনিটে ডি মারিয়া ও লো সেলসোকে তুলে নিয়ে দিবালা ও নিকোলাস গঞ্জালেজকে নামান স্কালোনি।  মাঠে নেমে আড়াই মিনিটের মধ্যেই জালের ঠিকানা খুঁজে নেন দিবালা।
 মাঝমাঠে অধিনায়ক মেসিকে পাস দিয়ে ওপরে উঠে যান দিবালা।  সাবলীল ড্রিবলিংয়ে ডি-বক্সের মুখে চলে যান মেসি।  তবে বলের নিয়ন্ত্রণ হারান ক্ষণিকের জন্য।  ক্ষতি হতে দেননি দিবালা।  সঙ্গে সঙ্গে বলটি ধরেই বাম পায়ের নিখুঁত শটে ডনারুম্মাকে পরাস্ত করেন এ তরুণ ফরোয়ার্ড।
দিবালার গোলের পরপরই বাজানো হয় ম্যাচের শেষ বাঁশি।  আর ম্যাচ শেষ হতেই অধিনায়ককে শূন্যে ভাসিয়ে আরও একটি আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের উল্লাস করে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা।  এসময় তাদের পরনে ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লেখা জার্সি।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ