ভাঙছে কক্সবাজার সৈকত, বিলীন হচ্ছে ঝাউবন

কক্সবাজার প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ভাঙছে।  আচড়ে পড়া বিশাল ঢেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে সৈকত সংলগ্ন ঝাউগাছ।  চলতি বর্ষা মৌসুমের অস্বাভাবিক জোয়ারের তান্ডবে ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।  আর ঢেউয়ের ঝাপটায় সরে যাচ্ছে বালু।  ইতোমধ্যে অস্বাভাবিক জোয়ার ও ঢেউয়ের তান্ডবে গাছপালাসহ বেশকিছু স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে।  ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সৈকতের শূন্য পয়েন্টে থাকা পাবলিক ওয়াশরুমও।  জোয়ারের পানিতে সৈকতপাড় তলিয়ে থাকায় পর্যটকদের বাধ্য হয়ে রাস্তায় কিংবা একটু উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে হচ্ছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কক্সবাজারের লাবণী পয়েন্টে সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাঁপটা পড়ছে সৈকত পাড়ে।  এতে করে সেখানে থাকা বালু সরে গিয়ে সংলগ্ন পাড় ও ঝাউবন ভাঙছে।  দীর্ঘ সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ঝাউগাছের মূল।  ঢেউয়ের ঝাপটায় গাছের মূল থেকে বালু সরে যাওয়ায় গাছ উপড়ে পড়েছে।  জোয়ারের সময় সমুদ্রস্নানে মারাত্মক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে পর্যটকদের।  এছাড়া সৈকতের সবুজ বেষ্টনী, সাগর লতা, দোকান-পাটও ঝুঁকিতে রয়েছে। জোয়ারের সময় সৈকতের বেলাভূমিতে এখন আর ওয়াকিং জোন থাকে না।  বর্তমানে এ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।  সৈকত ভাঙনরোধে দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন পর্যটক ও স্থানীয়রা।
সৈকতে বেড়াতে যাওয়া পর্যটক দম্পত্তি রেহান সোহেল ও তমা আনসারি দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, জোয়ারের পানিতে সৈকতপাড় পানিতে ডুবে থাকে।  ফলে রাস্তায় কিংবা একচু উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি উপভোগ করতে হয়।  এতো দূর থেকে এসে প্রকৃতির এমন আচরণে আমরা বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।  তাড়া সৈকতে পড়ে থাকা গাছের মূল কিংবা বিভিন্ন স্থাপনার ইট-পাথর ঝুঁকি তৈরি করছে।  এগুলো অপসারণ করা প্রয়োজন।
ঝাউবনের গাছ শুয়ে পড়ছে
জোয়ারের বিশালাকার ঢেউয়ে বিলীন হচ্ছে উপকূলবাসীর রক্ষাকবচ কক্সবাজার সৈকতের বালুচরের ঝাউবাগান।  গত কয়েকদিনের ব্যবধানে অন্তত এক হাজারের বেশি ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছে।  এসব গাছ বন বিভাগের লোকজন কিছুটা সংগ্রহ করতে পারলেও অধিকাংশ গাছ কেটে নিয়ে গেছে স্থানীয় অনেকে।  অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায় একটি সিন্ডিকেট এসব সরকারি ঝাউগাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে।  পাশাপাশি সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে গেছে অনেক গাছ।
ইতোমধ্যে সমুদ্রসৈকতের ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা সাগরে তলিয়ে গেছে।  এছাড়া সারি সারিভাবে দীর্ঘ সৈকতে পড়ে আছে হাজারও ঝাউগাছ।  কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২-৭৩ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের নাজিরারটেক, সমিতিপাড়া, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, লাবণী, কলাতলী, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, উখিয়ার ইনানী, সোনাপাড়া, টেকনাফের বাহারছড়া, মহেশখালীয়া পাড়া, সাবরাং উপকূলের প্রায় ৪৮৫ হেক্টর বালিয়াড়িতে ১২ লাখ ঝাউগাছ সৃজন করা হয়েছিল।
এছাড়া ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন বছরে আরো ১৮৫ হেক্টর বালুচরে সৃজন করা হয় ২ লাখের বেশি ঝাউগাছ।  কিন্তু গত ১০ বছরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ভাঙনে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে ৮ লাখের বেশি ঝাউগাছ।  ভাঙনরোধে সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রতিরক্ষা বাঁধ (জিও টিউব) দিয়েও ঝাউগাছ রক্ষা করতে পারছে না।  ঢেউয়ের তোড়ে জিও টিউব বাঁধও ভেঙে পড়েছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী জানান, উপকূল ও সৈকতের সৌন্দর্য রক্ষায় দ্রুত সময়ে বাঁধ নির্মাণ করে সমাধান জরুরি।  অন্যথায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ঝাউগাছ বিলীনের পাশাপাশি উপকূলবাসীও সাগরের করালগ্রাস থেকে রক্ষা পাবে না।
কক্সবাজারের পরিবেশ সংগঠন ইয়ুথ এর নির্বাহী পরিচালক ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ঝাউগাছ বিলীনের বিষয়টি দীর্ঘদিনের।  এ বিষয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে।  কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তর ঝাউবিথী রক্ষায় এগিয়ে আসেনি।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ন কবির জানান, প্রাকৃতিক কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃৃদ্ধি পেয়েছে।  এতে জোয়ারের সময় ঢেউয়ের ধাক্কায় ঝাউ গাছের গোড়া থেকে বালি সরে যাওয়ায় বিলীন হতে থাকে ঝাউবাগান।  তবে ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬৫০ হেক্টর জমিতে ঝাউগাছ লাগানো হয়েছে।  কিন্তু জোয়ারের পানিতে তার অর্ধেকের চেয়ে বেশি বিলীন হয়ে গেছে।  জরুরি প্রকল্পের আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বারা আধুনিক পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসককে একাধিকবার অবগত করা হয়েছে।

ডিসি/এসআইকে/এফআর