দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
চারপাশে সাগর, আর এই বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা নৈসর্গিক এ ভূখণ্ডে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক পরিবেশসম্মত সমৃদ্ধ এক মানবিক নগর। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আবাস হিসেবে বাংলাদেশের এ মেগা প্রকল্প। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মানবিক পদক্ষেপ। তাঁর স্বপ্নের মতো করেই সাজানো হয়েছে পুরো নব্য নগরটিকে
ভাষানচর একটি স্থায়ী দ্বীপ। এর আয়তন ১৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপটি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর ইউপির অন্তর্ভুক্ত। সাগরের বুকে জেগে ওঠা এ চরে বর্তমানে পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ঘরবাড়ি, মাঠ, জলাধার এবং ম্যানগ্রোভ বন। সুউচ্চ সাইক্লোন শেল্টার, নান্দনিক নকশার দালান, সুবিন্যস্ত পাকা-আধাপাকা সড়ক, সড়কের এক পাশে সারি সারি পিলারে লাইট, উচ্চ বেড়িবাঁধে সুরক্ষিত দ্বীপ, জাহাজ ভেড়াবার বিশাল জেটি, সারিসারি লাল রঙের আবাসন, চাষাবাদের উপযোগী ভূমি আর রাতে আলোর ঝলকানি, মানবহীন ভাসানচরের বর্তমান চিত্র এটি। নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ভাসানচর।
সাগরের বুকে জেগে ওঠা ভাসানচর এখনো লোকালয় হিসেবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু লোকালয়সমৃদ্ধ দ্বীপগুলো শত বছরেও যে আধুনিকতার ছোঁয়া পায়নি, ভাসানচর তার চেয়েও বেশি পেয়েছে মাত্র দুই বছরে। দেশের অসংখ্য পর্যটক মুখিয়ে আছে দ্বীপটিকে এক নজর দেখার জন্য।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কল্পনার চেয়েও সুন্দর এ ভাসানচর। সদ্য জেগে ওঠা দ্বীপ এমন দৃষ্টিনন্দন চেহারায় উদ্ভাসিত হতে পারে তা অকল্পনীয়। আর এমন হয়েছে নৌবাহিনীর সরাসরি তদারকিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার কর্মীর দিনরাত পরিশ্রমে। দ্বীপটি এখনই এক লাখ রোহিঙ্গা ধারণের জন্য প্রস্তুত। পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে আরো তিন লাখ মানুষের আবাসন।
কর্মকর্তারা বলেন, দ্বীপের ১৩ হাজার একর ভূমির মধ্যে ৬ হাজার ৪২৭ একর জায়গা জোয়ারের পানিতে ডোবে না। এ স্থানটুকু থেকে নির্বাচন করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩ এর ভূমি। ভাসানচরে প্রথম এসে আমরা কিছু মহিষ আর পাখি ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। পরে সড়ক সম্প্রসারণ, বেড়িবাঁধ উঁচুকরণ এবং কাজ বাড়ায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে উন্নীত হয় ৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকায়। কাজ প্রায় ৯৯ ভাগই শেষ। এখন পেইন্টিং এবং সৌন্দর্যবর্ধনের কিছু কাজ বাকি। যেটুকু হয়েছে এতে এক লাখ রোহিঙ্গা খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবেন।
তারা আরো বলেন, দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গায় তৈরি করা হয়েছে সুউচ্চ একটি লাইট হাউস। যার মাধ্যমে ওই চ্যানেলের জাহাজগুলো সাগরে চলাচলে সঠিক নির্দেশনা পাবে।
ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়ণের জন্য তৈরি হয়েছে ১২০টি ক্লাস্টার। প্রতিটি ক্লাস্টারে ১২টি হাউস, একটি সাইক্লোন শেল্টার, একটি পুকুর ও খেলার মাঠ নিয়ে একটি গুচ্ছগ্রাম। এভাবে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে নির্মিত হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি আবাসন ঘর। কোনো ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছাস হলে বসবাসকারীরা দ্রুতই আশ্রয় নিতে পারবে শেল্টারে। রয়েছে দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক। বসবাসকারীদের জন্য আছে রান্নাঘর, শৌচাগার ও পানীয় জলের সুবিধা।
অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে দুটি ফায়ার জিপসহ একটি ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ব্যারাক হাউসে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংযোজন করা হয়েছে। প্রতি ক্লাস্টারে নির্মিত পুকুরের পানিও অগ্নিনির্বাপন কাজে ব্যবহার করা যাবে। প্রতিটি শেডেই রয়েছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা। এছাড়া নৌবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতি থাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সুদৃঢ়। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা এলে যেন থাকতে পারেন সেজন্য নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বাংলো।
বর্তমানে ভাসানচরে রয়েছে মাত্র ৩০৬ জন রোহিঙ্গা। অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়ার সময় তারা ধরা পড়েন। টেকনাফের আশ্রয় শিবিরের পরিবর্তে তাদের রাখা হয়েছে ভাসানচরে। এরমধ্যে ৯৭ জন পুরুষ, ১৭৬ জন নারী ও ৩৩ জন শিশু রয়েছে। তবে পুরো পরিবার রয়েছে এমন নয়। তাদের স্বজনদের মধ্যে কেউ টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পে আবার কেউ রয়েছে বিদেশে। এখানে থাকা রোহিঙ্গাদের কৃষি, গবাধি পশু পালন, হস্তশিল্প ও পারিবারিক কাজে আগ্রহী করতে সাময়িক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
ডিসি/এসআইকে/এমএসএ