মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের, বাঁঁশখালী প্রতিনিধি >>>
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় সারা বছরই থাকে পল্লী বিদ্যুতের ভেল্কিবাজি। এখন চলছে তীব্র গরম ও রমজানের ইবাদত বন্দেগীর অতীব গুরুত্বপূর্ণ মাস মাহে রমজান। ইবাদতের জন্য রাত্রি জাগা থেকে শুরু করে সারাদিন সিয়াম পালন করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ। তারাবীহ্’র নামায, সেহেরী ও ইফতারের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই সময়েও বাঁশখালী জুড়ে লোডশেডিং অব্যাহত রয়েছে। বছরের সারা মাসে বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে এমনিতেই অতীষ্ট থাকেন বাঁশখালীবাসী। দিনের বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না; এমনকি রাতেও বিদ্যুৎতের লুকোচুরি চলে দীর্ঘ সময়জুড়ে। প্রচন্ড গরমের সঙ্গে বাঁশখালী জুড়ে চলছে নতুন নিয়মে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং।
দৈনিক গড়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৬ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হওয়া ছাড়াও অফিস-আদালতে কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। শিশু-বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে নানা জটিল অসুখে। উপজেলার প্রায় ৯৫ হাজার ৭৯৪ জন গ্রাহক বিদ্যুতের এসব অভিযোগ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও লাভ হচ্ছে না। মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং এর সাথে যদি কালবৈশাখীর একটু বাতাস হয় তবে বিদ্যুৎ অফিসের আর কোনো দেখা মিলে না। অঘোষিত গাছ কাটার নামে, জড়ো-হাওয়ার অজুহাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বিদ্যুৎ আর আসে না। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় যেন বিদ্যুতের ভেল্কিবাজি। এক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ আসতে না আসতেই বন্ধ হয়ে যায় অন্য এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ। এত ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে লাইট, টিভি, ফ্রিজ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রিক জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অন্য দিকে মহামারি করোনার এই দুর্যোগে কোনো ধরনের মিটার না দেখে ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল পাঠিয়ে রীতিমতো লুটপাটের মহরা চলছে উপজেলা জুড়ে। অস্বাভাবিক বিদ্যুৎবিল হাতে পেয়ে দিশেহারা গ্রাহকেরা।
বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় সুবিধাভোগী কর্মকর্তা ও দালাল চক্র মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রতি মিটারে অতিরিক্ত টাকা আদায়, পাড়ায় কিংবা মুরগি, গরু, মাছের খামারে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সেই সাথে বাঁশখালীর বিভিন্ন ইউনিয়নে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রেখে নিয়মিত শেখেরখীলের বরফ মিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে পল্লী বিদ্যুতের এই চক্রটির বিরুদ্ধে। সরকারিভাবে নতুন মিটার সংযোগ ৮৫০ টাকা হলেও অনেক জায়গায় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন ঘর-বাড়িতে কোনো মানুষ না থাকা সত্বেও গড়/অনুমাননির্ভর বিদ্যুৎ বিল নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি নিয়মনীতি থাকা সত্বেও কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখে পল্লী বিদ্যুৎ। এর পেছনের কারণ হিসেবে জানা গেছে, যে সমস্ত অবৈধ সংযোগ আছে সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং উপরি ইনকামের বাড়তি সময়জুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বরফকলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। ফলে স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দির-গীর্জাসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশনসহ নানান কাজ বন্ধ হয়ে যায়। গরমে সাধারণ মানুষ ঘরে থাকতে পারছে না।
পল্লী বিদ্যুৎ বাঁঁশখালী জোনাল অফিস সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় বর্তমানে প্রায় ৯৫ হাজার ৭৯৪ গ্রাহক রয়েছে। তৎমধ্যে আবাসিক গ্রাহক ৮৭ হাজার, বাণিজ্যিক ৫ হাজার ২’শ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ১০ হাজার, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ ৫ শতাধিক। সেচ সংযোগ রয়েছে সাড়ে ৬’শটি। এছাড়া রয়েছে পৌরসভার সড়কবাতি। উপজেলায় ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র ১টি (২০ এমভিএ)। বর্তমানে ৪ টি সাব স্টেশন চালু করা হয়েছে। তবে এ সমস্ত সাব স্টেশনগুলোতে সর্বোচ্চ লোড নিতে পারে ২৫.৫০ মেগাওয়াট। ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভাসহ ৩৯৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলায় প্রায় ১৫০ টিরও অধিক গ্রাম শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে চলতি মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার নতুন মিটার সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
কালীপুর ইউপির বাসিন্দা মো. রমিজ উদ্দীন বলেন, এই করোনার মধ্যে মানুষ বাঁচবে কিনা জানি না। অনেকের ঘরে খাওয়ার মত ব্যবস্থাও নেই। আমি দিন মজুর মানুষ। ২ মাস যাবৎ কোনো কাজ-কাম নাই। চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে; তার মধ্যে বিদ্যুৎ বিল দিল ডাবল। আমরা খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। তার মধ্যে বিল নিয়ে মহাটেনশনে আছি। কি করব বুঝতেছি না।
শেখেরখীল ইউপির বাসিন্দা মো. ইব্রাহীম বলেন, ‘আই রিক্সা চালাই ভাত হাই। ২ মাস যাবৎ ঘরত্তুন বাইর অইত না পারির, হষ্ট গরি চলির। হাইবার ভাত নাই ঘরত। আবার বিদ্যুতুর বিল দিইয়্যে ডাবল। এহন কেন গইরগম বুঝিত না পারির। কি ভাত হাইয়ম না বিদ্যুৎ’র বিল দিয়ম’ (আমি রিক্সা চালিয়ে ভাত খাই। ২ মাস ধরে ঘর থেকে বের হতে পারি না, কষ্ট করে চলছি। ঘরে ভাত নেই। এরমধ্যে বিদ্যুতের বিল করা হয়েছে দ্বিগুন। এখন কি করব বুঝতে পারছি না। ভাত খাবো না বিদ্যুৎ বিল দিবো)।
বাহারচড়া এলাকার ওসমান জানান, আমি বেসরকারি শিক্ষক। ২ মাস যাবৎ ঘরে বসে আছি। কোনো আয় রোজগার নাই। কষ্ট করে ধার-কর্য নিয়ে চলতেছি। কেমনে বাঁচব পরিবার-পরিজন নিয়ে বুঝতে পারি না। বিদ্যুৎ বিল পেয়ে এখন আরো মহাটেনশনে আছি। এই লকডাউনের মধ্যে বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করা যেখানে সরকারের উচিত ছিল। সেখানে বিদ্যুৎ বিল দিল দ্বিগুন। ২ মাসের বিদ্যুৎ বিল হাফ করে দিলে সাধারণ জনগণের একটু হলেও উপকার হতো।
চাম্বল ইউপির বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বাঁশখালী পল্লী বিদ্যুৎতের অতিরিক্ত লোডশেডিং এর কারণে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। এমনকি এই পবিত্র রমজান মাসে তারাবীহ, সেহেরী ও ইফতার করার সময় পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকে না। যার ফলে মানুষ এবাদাত বন্দেগী করতে কষ্ট পাচ্ছেন। ঘন ঘন লোডশেডিং এর কারণে অনেক মূলবান জিনিষপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তীব্র গরমে ছোট ছেলে-মেয়েদের এবং অসুস্থ রোগীদের দুর্ভোগ কেউ দেখেন না।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ বাঁঁশখালী জোনাল অফিসের অতিরিক্ত ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. মফিজুল ইসলাম দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, লোডশেডিংয়ের বর্তমান সমস্যা আমাদের না। এটি চন্দনাইশ গ্রিডের সমস্যা। কারণ দোহাজারী থেকে সাতকানিয়া হয়ে দীর্ঘ ৪৬ কিলোমিটার অতিক্রম করে বাঁশখালীতে বিদ্যুৎ আসে। তবে গুণাগরি থেকে সাতকানিয়া হয়ে রাস্তা পাহাড়ি এবং অতিরিক্ত খারাপ হওয়ায় বিভিন্ন সময় জনবল সংকট হওয়ার কারণে অনেক সময় ত্রুটি সৃষ্টি হয়। এ গ্রিডে ২৮ মেগাওয়াট লোড নিতে পারে। এর মধ্যে ইনকামিং ব্রেকারে কারিগরি সমস্যার কারণে তা সম্পূর্ণ লোড নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে আমরা চাহিদা মতো বিদ্যুৎ পেলেও লোডশেডিং হচ্ছে অতিরিক্ত। উক্ত লাইনে ২ মাসে প্রায় ৫৫২ রাইট অব ওয়ে করণ (কি.মি.) সম্পন্ন করেছি এবং ৬ টি ওভার লোডেড ট্রান্সফরমার পরির্বতন করেছি। যার কারণে এই লোডশেডিং হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ৩৯৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই বাঁশখালীতে চাহিদা অনুসারে দৈনিক ২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন, আমরা তা পাচ্ছিও। আমাদের উপজেলা সদরের জোনাল অফিস ও সাব স্টেশনসহ ৪টি অফিসে মিলে মাত্র ৯৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। তা দিয়ে আমরা পুরো বাঁশখালীতে চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে পারছি না। অন্তত আরো ১২ থেকে ১৫ জন লোক দরকার। লাইনম্যান আছে মাত্র ২৭ জন, স্বাভাবিতভাবে কাজ করতে গেলে অন্তত আরো ৮ থেকে ১০ জন লাইনম্যান প্রয়োজন। জনবল ঘাটতি থাকার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে।
সরকারিভাবে নতুন মিটার নিতে মাত্র ৮৫০ টাকা লাগে, কিন্তু অভিযোগ রয়েছে নতুন সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৫-৮ হাজার টাকাও নেয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগ আমরাও শুনেছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ লিখিত কোনো অভিযোগ দেননি। যারা নতুন সংযোগ নিতে আগ্রহী তারা সরাসরি অফিসে কিংবা আমার কাছে এসে যোগাযোগ না করে কিভাবে দালালদের টাকা দেন? এ গুলো নিজেদের সচেতনতার অভাব। ইতোমধ্যে নতুন সমস্ত মিটারগুলোর সংযোগ দেওয়া হয়ে গেছে।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে গ্রাহক ও কর্মকর্তা কর্মচারীর নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটি রিডিং দেখা সম্ভব হয়নি বিধায় কিছু কিছু গ্রাহকের গড় বিল করা হয়েছে। গত মার্চ-এপ্রিল এ অন্যান্য মাসের তুলনায় গ্রাহকেরা বেশী বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে। কারণ ২ মাসে আমরা বিদ্যুৎ ক্রয় করেছি ৯৮ লক্ষ ৮ হাজার ৩০৩ (কিঃ ওঃ ঘঃ)। তারমধ্যে আমরা বিদ্যুৎ বিক্রি করেছি ৮০ লক্ষ ৮২ হাজার ৪৮ (কিঃওঃঘঃ)। ইতোমধ্যে আমরা বিদ্যুৎ বিল পেয়েছি প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। আরো অন্তত ১০ কোটি টাকার বিদ্যুৎতের বিল আমরা পাইনি। তবে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনের সচিব মো. রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গত ২৪ মার্চের এক প্রজ্ঞাপনে আবাসিক গ্রাহকশ্রেণির (এলটি-এ এবং এমটি-১) ক্ষেত্রে মার্চ-এপ্রিল মাসের বিদ্যুৎ বিলের বিলম্ব-পরিশোধ মাশুল মওকুফ করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। যদি কোনো গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় তাহলে বিদ্যুৎ বিলের কপি ও বর্তমান মিটারের রিডিং ছবিসহ আমাদের অফিসে যোগাযোগ করলে আমরা সংশোধন করে এটার সমাধান দিব।
তিনি জানান, কর্ণফুলী থানাধীন শাহমীরপুর থেকে তৈলারদ্বীপ ব্রিজ সংলগ্ন সাঙ্গু নদী ক্রস করে আরেকটি ৩৩ হাজার কেভির নতুন লাইন বাঁশখালীতে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, ডিজাইনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়াও কক্সবাজার থেকে চকরিয়া-পেকুয়া হয়ে বাঁশখালীতে আরো একটি বিদ্যুৎ লাইন আসছে। তবে এই ২টা নতুন লাইন যদি বাঁশখালীতে ঢুকে; তাহলে খুব শীঘ্রই বাঁশখালীবাসী বিদ্যুতের লোডশেডিং থেকে মুক্ত থাকবেন।
ডিসি/এসআইকে/এমএমবিটি